ভারত সবসময়ই পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে: পাক সেনা

ভারত সবসময়ই পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়েঃ পাক সেনা

ভারত সবসময়ই পাকিস্তানের চেয়ে একধাপ এগিয়ে বলে মন্তব্য করেছেন অবসরপ্রাপ্ত এক পাক সেনা কর্মকর্তা। পাকিস্তানের সাবেক আর্মি জেনারেল গুলাম মুস্তাফা রবিবার বলেছেন, কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের ঘটনাই হোক, বা সেনা মুভমেন্ট-সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে রয়েছে ভারত।
তিনি আরও দাবি করেছেন, স্ট্র্যাটেজিক চিন্তাভাবনাতেও বেশ পিছিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। আর সেখানেই ভারতের কাছে বারবার পিছিয়ে পড়ে তারা।
পাক এ সেনার এমন মন্তব্যে শোরগোল পড়েছে পাকিস্তানে।
পাক সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাতকারে গুলাম মুস্তাফার দাবি, ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের বিষয়টি নিয়ে এখন হইচই করলেও, আগে থেকে ভারতের পদক্ষেপ সম্পর্কে কোনও ধারণাই করতে পারেনি পাকিস্তান, তার কারণ তাঁদের মধ্যে দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে। কোনও কিছুর ভবিষ্যত নিয়ে পাকিস্তান ভাবে না।
কাশ্মীর ইস্যুতে গোলাম মুস্তাফা বলেন, পাকিস্তান এরকম করে ভাবতেই পারবে না। তাঁদের চিন্তাভাবনার সংকীর্ণতাই বেশ কয়েক ধাপ পিছিয়ে দিয়েছে ভারতের থেকে।
সাবেক এই পাক সেনার বক্তব্যে ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের প্রসঙ্গও উঠে আসে। তিনি বলেন, ওই যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। কারণ, ভারত যেভাবে হামলা চালিয়েছিল, পাকিস্তান একেবারেই তার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
আগস্টের শুরুর দিকে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তুলে নেয় বিজেপি শাসিত ভারত সরকার। এরপর থেকে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। সেইসঙ্গে দেশ দুইটির সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে।
ইত্তেফাক/এসআর


সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (৩০ অক্টোবর ১৯০১ - ২৫ জুন ১৯৬০) বাংলা ভাষার একজন প্রধান আধুনিক কবি। বিংশ শতকের ত্রিশ দশকের যে পাঁচ জন কবি বাংলা কবিতায় রবীন্দ্র প্রভাব কাটিয়ে আধুনিকতার সূচনা ঘটান তাদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ অন্যতম। তাঁকে বাংলা কবিতায় “ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক” বলা হয় ! 

জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে বেশি নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা। সর্বব্যাপী নাস্তিকতা, দার্শনিক চিন্তা, সামাজিক হতাশা এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবাদ তাঁর কবিতার ভিত্তিভূমি। ত্রিশের অনান্য কবিরা অবিশ্বাসী হলেও সুধীন্দ্রনাথ দত্তই ঈশ্বরকে সরাসরি প্রত্যাখান করেছেন বলে হুমায়ুন আজাদ মনে করেন। আবদুল মান্নান সৈয়দ সুধীন্দ্রনাথের কবিতা সম্পর্কে বলেছেন,প্রসঙ্গ, প্রকরণ ও বিন্যাস-যার কথাই ভাবি না কেন, নব নব গন্তব্যে পৌঁছুনোর উচ্চাশা কবির নেই। নেই রাবীন্দ্রিক শতবিচিত্রতা, একই কথা প্রায় একই ভঙ্গিতে তিনি বিভিন্ন কাব্যকোরাসে বলেছেন। একই কথা, কিন্তু দ্বিতীয় রহিত। অর্থাৎ সহজীবি কবিদের থেকে একেবারে আলাদা। তাঁর প্রকাশরীতি ও অভিজ্ঞতার পরিধি ছোট, ছোট কিন্তু গভীর, আর নিখুঁত নিটোল, নিজস্ব ও সমস্ত সুন্দর।

উটপাখি
আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি ?
কেন মুখ গুঁজে আছো তবে মিছে ছলে ?
কোথায় লুকাবে ? ধূ-ধূ করে মরুভূমি ;
ক্ষ’য়ে-ক্ষ’য়ে ছায়া ম’রে গেছে পদতলে ।
আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই ;
নির্বাক, নীল, নির্মম মহাকাশ ।
নিষাদের মন মায়ামৃগে ম’জে নেই ;
তুমি বিনা তার সমূহ সর্বনাশ ।
কোথায় পলাবে ? ছুটবে বা আর কত ?
উদাসীন বালি ঢাকবে না পদরেখা ।
প্রাকপুরাণিক বাল্যবন্ধু যত
বিগত সবাই, তুমি অসহায় একা ।।
ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে ?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া ।
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে ?
কেবল শূন্যে চলবে না আগাগোড়া ।
তার চেয়ে আজ আমার যুক্তি মানো,
সিকতাসাগরে সাধের তরণী হও ;
মরুদ্বীপের খবর তুমিই জানো,
তুমি তো কখনো বিপদ্‌প্রাজ্ঞ নও ।
নব সংসার পাতি গে আবার  চলো
যে-কোনও  নিভৃত কণ্টকাবৃত বনে ।
মিলবে সেখানে অনন্ত নোনা জলও,
খসবে খেজুর মাটির আকর্ষণে ।।
কল্পলতার বেড়ার আড়ালে সেথা
গ’ড়ে তুলবো না লোহার চিড়িয়াখানা ;
ডেকে আনবো না হাজার হাজার ক্রেতা
ছাঁটতে তোমার অনাবশ্যক ডানা ।
ভূমিতে ছড়ালে অকারী পালকগুলি,
শ্রমণশোভন বীজন বানাবো তাতে ;
উধাও তারার উড্ডীন পদধূলি ।
পুঙ্খে পুঙ্খে খুঁজব না অমারাতে ।
তোমার নিবিদে বাজাব না ঝুমঝুমি,
নির্বোধ লোভে যাবে না ভাবনা মিশে ;
সে-পাড়াজুড়ানো বুলবুলি নও তুমি
বর্গীর ধান খায় যে ঊন্‌তিরিশে ।।

আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দু-জনে সমান অংশীদার
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,
আমাদের ‘পরে দেনা শোধবার ভার ।
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি ।
অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে ?
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি ।
ভ্রান্তিবিলাস সাজেনা দুর্বিপাকে ।
অতএব এসো আমরা সন্ধি ক’রে
প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি :
তুমি নিয়ে চল আমাকে লোকোত্তরে,
তোমাকে বন্ধু আমি লোকায়তে বাঁধি ।
শাশ্বতী
শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে,
প্রাঙ্গণে মেলে দিয়েছে শ্যামল কায়া ;
স্বর্ণ সুযোগে লুকাচুরি-খেলা করে
গগনে-গগনে পলাতক আলো-ছায়া।
আগত শরৎ অগোচর প্রতিবেশে ;
হানে মৃদঙ্গ বাতাসে প্রতিধ্বনি :
মূক প্রতীক্ষা সমাপ্ত অবশেষে,
মাঠে, ঘাটে, বাটে আরব্ধ আগমনী।
কুহেলীকলুষ, দীর্ঘ দিনের সীমা
এখনই হারাবে কৌমুদীজাগরে যে ;
বিরহবিজন ধৈর্যের ধূসরিমা
রঞ্জিত হবে দলিত শেফালি শেজে।
মিলনোত্সবে সেও তো পড়েনি বাকী,
নবান্নে তার আসন রয়েছে পাতা :
পশ্চাতে চায় আমারই উদাস আঁখি ;
একবেণী হিয়া ছাড়ে না মলিন কাঁথা।
একদা এমনই বাদলশেষের রাতে—
মনে হয় যেন শত জনমের আগে—
সে এসে সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে ;
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে ;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী ;
একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি ;
একটি পণের অমিত প্রগলভতা
মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ’রে
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ ছেড়ে দিল অকাতরে।।
সন্ধিলগ্ন ফিরেছে সগৌরবে ;
অধরা আবার ডাকে সুধাসংকেতে,
মদমুকুলিত তারই দেহসৌরভে
অনামা কুসুম অজানায় ওঠে মেতে।
ভরা নদী তার আবেগের প্রতিনিধি,
অবাধ সাগরে উধাও অগাধ থেকে ;
অমল আকাশে মুকুরিত তার হৃদি
স্বাতি মণিময় তারই প্রত্যভিষেকে।
স্বপ্নালু নিশা নীল তার আঁখি-সম ;
সে-রোমরাজির কোমলতা ঘাসে-ঘাসে ;
পুনরাবৃত্ত রসনায় প্রিয়তম ;
কিন্তু সে আজ আর কারে ভালোবাসে।
স্মৃতিপিপীলিকা তাই পুঞ্জিত করে
আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা :
সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না ।
জাতিস্মর
নাথু সংকটে হাঁকে তিব্বতী হাওয়া ।
প্রাকৃত তিমিরে মগ্ন চুমলহরি ।
ছঙ্গু-সায়রে কার বহিত্র যাওয়া
অপর্ণ বনে দিয়েছে রহস ভরি ।।

সুহৃদ আগুন নিবে গেছে গৃহকোণে ;
শ্রান্তসাথীরা স্বপনে আপনহারা ;
আমি শুধু বসে তুষারিত বাতায়নে
প্রহরে প্রহরে গুণি খসে কত তারা ।।
অঙ্গ তুহিন, তপ্ত আমার মাথা,
ক্লান্ত, তথাপি নিদ্রা আসে না ডাকে ;
বাণীহীন কোন্‌ অনাদি বিষাদগাথা
গুঞ্জরে বিস্মরণের ফাঁকে ফাঁকে ।।
হিমানীবিজন এই দুর্গম দেশে,
মনে হয় যেন, কে আমার অনুগামী ;
হয়তো বা আমি ভুলে গেছি আজ কে সে,
কিন্তু ভোলেনি তারে অন্তর্যামী ।।
বিগত জনমে, এই পর্বতশিরে,
এমনই নীরব প্রাগিতিহাসিক রাতে
শিকার সমাপি এসেছিনু ঘরে ফিরে
মৃগের বদলে তাহারে কি ল’য়ে সাথে ? 
মিনতি আমার প্রথমে ধরেনি কানে ;
কুতিল ভ্রুকুটি মোছেনি ললাটে ত্বরা ;
তার পরে কেন – তা কেবল সেই জানে-
অযাচিতে হল সহসা স্বয়ংবরা ।। 
চ্যুত বল্কলে নিবে গেল দীপখানি ;
বাহিরের হিম মুকুরিল দ্রব চোখে ;
হঠাৎ তাহার লঘু ভাস্বর পাণি
খুঁজিল আমারে প্রাক্তন নিরালোকে ।। 
আবার কি তার আদিম নিমন্ত্রণী
আহ্বানে মরে অমৃতের অভিসারে ?
কাঁদে সেদিনের প্রণব প্রতিধ্বনি
প্রতন গিরির গহ্বরকারাগারে? 
পুরাণপুরুষ ছাড়া পাবে নিমেষে কি?
মাটির মানুষ মিলিবে মাটির সনে?
বিদগ্ধ প্রাণী, এ কি মরীচিকা দেখি ?
ফিরিব প্রভাতে পরিচিত পরিজনে । 
মৌল আকূতি মরমেই যাবে ম’রে।
জনশুন্যতা সদা মোরে ঘিরে রবে।
সামান্যাদের সোহাগ খরিদ ক’রে
চিরন্তনীর অভাব মিটাতে হবে ।
বর্বর বায়ু চিরায়ু অচলচূড়ে
মুছে দিবে মোর অশুচি পায়ের রেখা ।
মার্জিতরুচি জনপদে ,বহু দূরে,
ভিড়ে মিশে আমি ভেসে যাব একা একা ।
অপচয়
প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্‌ময় রজনী,
ফেনিল মদিরা-মত্ত জনতার উল্বণ উল্লাস,
বাঁশির বর্বর কান্না,মৃদঙ্গের আদিম উচ্ছ্বাস,
অন্তরের অন্ধকারে অনঙ্গের লঘু পদধ্বনি ? 
আছে কি স্মরনে,সখী, উৎসবের উগ্র উন্মাদনা,
করদ্বয়ে পরিপ্লুতি, চারি চক্ষে প্রগল্‌ভ বিস্ময়,
শুন্য পথে দুটি যাত্রী, সহসা লজ্জার পরাজয়,
প্রতিজ্ঞার বহুলতা,আশ্লেষের যুগ্ম প্রবর্তনা ? 
সে-শুদ্ধ চৈতন্য, হায়, বৃথা তর্কে আজি দিশাহারা,
বন্ধ্য স্পর্শে পরিণত স্বপ্নপ্রসূ সে-গাঢ় চুম্বন ;
ভ্রাম্যমাণ আলেয়ারে ভেবেছিল বুঝি ধ্রুবতারা,
অকূল পাথারে তাই মগ্নতরী আমার যৌবন।। 
মরে না দুরাশা তবু ; মনে হয় এ-নিঃস্ব জগতে
এতখানি অপচয় ঘটাবে না বিধি কোনও মতে ।।
সৃষ্টিরহস্য
আয়ুর সোপানমার্গ বহু কষ্টে অতিক্রম করি
উন্মুক্ত মৃত্যুর প্রান্তে ঊর্ধ্বমুখে দাঁড়ায়েছি এসে ;
সিন্ধুর ভাস্বর আঁখি খোঁজে মোরে নিম্নে নিরুদ্দেশে ;
আমার আরতিদীপ মহাশুন্যে সাজায় শর্বরী ।। 
সম্মুখে নিখিল নাস্তি, পৃষ্ঠদেশে মৌল নীরবতা ;
প্রশান্তি দক্ষিণে, বামে ; জনহীন, অন্তর,বাহির।
তবু কার আবির্ভাবে  কণ্টকিত আমার শরীর ;
অবচেতনার তলে গুমরে কী জাতিস্মর কথা? 
তবে কি বিরাট শূন্য শূন্য নয়, সাগরের প্রেত ;
উদ্বেল বিক্ষোভ তার পরিণত বিদেহ ঈথারে?
তবে কি দুর্মর মর্ত্য ক্রন্দসীতে ক্রন্দন বিথারে;
শস্যের মিসরী শবে উপ্ত সম্ভাবনার সংকেত ? 
নির্লিপ্ত আলোর দ্বীপ নয় ওই দিব্য নীহারিকা,
কালের প্রপাতে মগ্ন বাসনার ভাসমান ফেনা ?
অবচ্ছিন্ন তারারাশি, ওরা চিরদিনকার চেনা
পশুদের স্থুল সত্তা, লালসার মূর্ত বিভীষিকা ? 
নাই নাই মৌন নাই, সর্বব্যাপী বাঙ্‌ময় জগৎ ;
নির্বাণ বুদ্ধির স্বপ্ন, মৃত্যুঞ্জয় জ্বলন্ত হৃদয় ;
হয়ত মানুষ মরে, কিন্তু তার বৃত্তি বেঁচে রয় ;
জন্ম হতে জন্মান্তরে সংক্রমিত প্রত্ন মনোরথ ।। 
কপোল কল্পনা ত্যাগ ; নিরাসক্তি অসাধ্যসাধন;
অনন্তপ্রস্থান মিথ্যা ; সত্য শুধু আত্মপরিক্রমা ;
বিদ্রোহে স্বাতন্ত্র্য নাই ; মুক্তি মানে নিরুপায় ক্ষমা ;
সৃষ্টির রহস্য মাত্র আলিঙ্গন, পুনরালিঙ্গন ।।

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা


শক্তি চট্টোপাধ্যায় (জন্ম: নভেম্বর ২৫, ১৯৩৪ - মৃত্যু: মার্চ ২৩, ১৯৯৫) ছিলেন ভারতীয় বাঙালি কবি, ওপন্যাসিক, লেখক ও অনুবাদক, যিনি জীবনানন্দ-উত্তর যুগের বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান আধুনিক কবি হিসেবে বিবেচিত।[ বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত এবং আলোচিত ছিলেন। ষাটের দশকে যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলনের জনক মনে করা হয় তাদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম।
১৯৮২ সালে প্রকাশিত তার যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো কাব্যগ্রন্থ ইংরেজি এবং মৈথিলী বাষায় অনুদিত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত ছেঁড়া তমসুখ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

শক্তিমান কবি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা 

যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?

ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।

এতো কালো মেখেছি দু হাতে
এতোকাল ধরে!
কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি।

এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়

যেতে পারি
যে-কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাবো?

সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো

যাবো
কিন্তু, এখনি যাবো না
তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবো
একাকী যাবো না, অসময়ে।।

মনে মনে বহুদূর চলে গেছি
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি – যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয় –
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু – প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন –
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে

অবনী বাড়ি আছো
অবনী বাড়ি আছো
অবনী বাড়ি আছো
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’

বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’

আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছ?’

পাবো প্রেম কান পেতে রেখে

বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে ব’সে আছো, দেবতা আমার ।
শিকড়ে, বিহ্বল প্রান্তে, কান পেতে আছি নিশিদিন
সম্ভ্রমের মূল কোথা এ-মাটির নিথর বিস্তারে ;
সেইখানে শুয়ে আছি মনে পড়ে, তার মনে পড়ে ?

যেখানে শুইয়ে গেলে ধীরে-ধীরে কত দূরে আজ !
স্মারক বাগানখনি গাছ হ’য়ে আমার ভিতরে
শুধু স্বপ্ন দীর্ঘকায়, তার ফুল-পাতা-ফল-শাখা
তোমাদের খোঁড়া-বাসা শূন্য ক’রে পলাতক হলো ।

আপনারে খুঁজি আর খুঁজি তারে সঞ্চারে আমার
পুরানো স্পর্শের মগ্ন কোথা আছো ? বুঝি ভুলে গেলে ।
নীলিমা ঔদাস্যে মনে পড়ে নাকো গোষ্ঠের সংকেত ;
দেবতা সুদূর বৃক্ষে, পাবো প্রেম কান পেতে রেখে ।

একবার তুমি

একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা কর–
দেখবে, নদির ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে
পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল
নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল
একবার তুমি ভাল বাসতে চেষ্টা কর ।

বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল–ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়
সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে
যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার, যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সলমা-চুমকি-জরি-মাখা প্রতিমা
বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটেনক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি ।

বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল
চিঠি-পত্রের বাক্স বলতে তো কিছু নেই–পাথরের ফাঁক-ফোকরে রেখে এলেই কাজ হাসিল–
অনেক সময় তো ঘর গড়তেও মন চায় ।

মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে
আমাদের সবই দরকার । আমরা ঘরবাড়ি গড়বো–সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো ।

রূপোলি মাছ পাথর ঝরাতে-ঝরাতে চলে গেলে
একবার তুমি ভালবাসতে চেষ্টা করো ।

হেমন্ত যেখানে থাকে

হেমন্ত যেখানে থাকে, সেখানে কৌতুক থাকে গাছে
সাড়া থাকে, সচ্ছলতা থাকে।
মানুষের মতো নয়, ভেঙে ভেঙে জোড়ার ক্ষমতা
গাছেদের কাছে নেই
হেমন্ত বার্ধক্য নিতে আসে
খসায় শুকনো ডাল, মড়া পাতা, মর্কুটে বাকল
এইসব।
হেমন্ত দরোজা ভেঙে নিয়ে আসে সবুজ নিশ্বাস…
মানুষের মতো নয় রক্তে পিত্তে সৌভাগ্য সরল
শিশুটির মতো রাঙা ক্রন্দন ছিটিয়ে চারিপাশে
হেমন্ত যেখানে থাকে, সেখানে কৌতুক থাকে গাছে।।

এক অসুখে দুজন অন্ধ

আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ
দীর্ঘ দাঁতের করাত ও ঢেউ নীল দিগন্ত সমান করে
বালিতে আধ-কোমর বন্ধ
এই আনন্দময় কবরে
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ ।

হাত দুখানি জড়ায় গলা, সাঁড়াশি সেই সোনার অধিক
উজ্জ্বলতায় প্রখর কিন্তু উষ্ণ এবং রোমাঞ্চকর
আলিঙ্গনের মধেযে আমার হৃদয় কি পায় পুচ্ছে শিকড়
আঁকড়ে ধরে মাটির মতন চিবুক থেকে নখ অবধি ?

সঙ্গে আছেই
রুপোর গুঁড়ো, উড়ন্ত নুন, হল্লা হাওয়ার মধ্যে, কাছে
সঙ্গে আছে
হয়নি পাগল
এই বাতাসে পাল্লা আগল
বন্ধ ক’রে
সঙ্গে আছে …
এক অসুখে দুজন অন্ধ !
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ ।

দিন যায়

সুখের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শীতের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
অর্ধেক কপাল জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শুধু ঝড় থমকে আছে গাছের মাথায়
আকাশমনির ।

ঝড় মানে ঝোড়ো হাওয়া, বাদ্ লা হাওয়া নয়
ক্রন্দনরঙের মত নয় ফুলগুলি
চন্দ্রমল্লিকার ।

জয়দেবের মেলা থেকে গান ভেসে আসে
সঙ্গে ওড়ে ধুলোবালি, পায়ের নূপুর
সুখের চট্ কা ভাঙে গৈরিক আবাসে
দিন যায় রে বিষাদে, ষাদে, মিছে দিন যায় …

ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ

ইচ্ছে ছিলো তোমার কাছে ঘুরতে-ঘুরতে যাবোই
আমার পুবের হাওয়া।
কিন্তু এখন যাবার কথায়
কলম খোঁজে অস্ত্র কোথায়
এবং এখন তোমার পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা কুঞ্জলতায়
রক্তমাখা চাঁদ ঢেকেছে
আকুল চোখ ও মুখের মলিন
আজকে তোমার ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ পুবের হাওয়া।।

চাবি

আমার কাছে এখনো পড়ে আছে
তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি
কেমন করে তোরংগ আজ খোলো?

থুতনিপরে তিল তো তোমার আছে
এখন? ও মন নতুন দেশে যাবি?
চিঠি তোমায় হঠাত্‍ লিখতে হলো ।

চাবি তোমার পরম যত্নে কাছে
রেখেছিলাম, আজই সময় হলো -
লিখিও, উহা ফিরত্‍ চাহো কিনা?

অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু-ঝলোমলো
লিখিও, উহা ফিরত্‍ চাহো কি না?

স্টেশন ভাসিয়ে বৃষ্টি

মনে পড়ে স্টেশন ভাসিয়ে বৃষ্টি রাজপথ ধ’রে ক্রমাগত
সাইকেল ঘন্টির মতো চলে গেছে, পথিক সাবধান…
শুধু স্বেচ্ছাচারী আমি, হাওয়া আর ভিক্ষুকের ঝুলি
যেতে-যেতে ফিরে চায়, কুড়োতে-কুড়োতে দেয় ফেলে
যেন তুমি, আলস্যে এলে না কাছে, নিছক সুদূর
হয়ে থাকলে নিরাত্মীয় ; কিন্তু কেন? কেন, তা জানো না।
মনে পড়বার জন্য? হবেও বা । স্বাধীনতাপ্রিয়
ব’লে কি আক্ষেপ? কিন্তু বন্দী হয়ে আমি ভালো আছি।

তবু কোনো খর রৌদ্রে, পাটকিলে কাকের চেরা ঠোঁটে
তৃষ্ণার চেহারা দেখে কষ্ট পাই, বুঝে নিতে পারি
জলের অভাবে নয়, কোন টক লালার কান্নায়
তার মর্মছেঁড়া ডাক; কাক যেন তোমারই প্রতীক
রূপে নয়, বরং স্বভাবে – মনে পড়ে, মনে পড়ে যায়
কোথায় বিমূঢ় হয়ে বসে আছো হাঁ-করা তৃষ্ণায়!

সেই হাত

অভিনব দুটি হাতে দেয়াল দরোজা খুলে দাও।
ততক্ষণে রোদ্দুর পৌচেছে
গোটারাত ঘুরে ঘুরে রোদ্দুর পৌঁচেছে
ঘরে।
কিছুটা নড়বড়ে
ছিলো ঘর।
এককোণে পাথর
তেমন সন্তুষ্ট নয়, ‘দখল দখল শব্দ করে।
দাবি তার ঘরটি ভরাবে
মানুষের মাথায় চড়াবে
তার ভার।
আর
যদি পারে
গিলে খাবে মানুষের স্বপ্ন নিয়ে বাঁচা
অন্ধকারে!
তা কি হয়?
রোদ্দুরের ফুল ফোটে
ঘরে যে-হাতে দরোজা খোলো
সেই হাত শানাও পাথরে!