বিশপ পনেন পল কুবি সিএসসি

হা'বিমানি রা'সং

হা'বিমানি রাসং
বিশপ পনেন পল কুবি সিএসসি'র সংক্ষিপ্ত জীবনী।




বিশপ পনেন পল কুবি সিএসসি হচ্ছেন বিশ্বে মান্দি জাতির মধ্যে এবং বাংলাদেশে আদিবাসী ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রথম বিশপ । যে গ্রাম ও পরিবেশ থেকে তিনি এ পর্যায়ে উঠে এসেছেন তা এতোটা সহজ ছিল না। তৎকালীন হা’বিমার মান্দি এলাকা শিক্ষায় দীক্ষায় পিছিয়ে ছিল অন্যান্য মান্দি এলাকার মান্দিদের থেকে। গভীর জঙ্গলে আবৃত ছিল গোটা হা’বিমা এলাকা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুব একটা ছিল না। তাছাড়া , অভিভাবকদেরও শিক্ষার প্রতি ছিল না তেমন আগ্রহ। তেমনই গ্রাম, সমাজে থেকে , বাড়ি থেকে ৩-৪ কিলো দূরে জঙ্গুলে পথে হেঁটে গিয়ে পড়াশোনা করে এ পর্যন্ত আসা এবং নিজেকে সমাজের কাছে, জাতির কাছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা চাটিখানি কথা নয়। তাঁর আগে কেউ ফাদার হননি গোটা হা’বিমা এলাকায়। তিনিই ছিলেন হা’বিমার প্রথম ফাদার এবং তিনিই কিনা হলেন মান্দিদের মধ্যে প্রথম বিশপও। হয়তো, ঈশ্বর চেয়েছিলেন বলেই তা ঘটেছিল।

বিশপ পনেন পল কুবি সিএসসি-র জন্ম দেওয়াচালা গ্রামে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন। পিতার নাম মনিন্দ্র মাইকেল দালবৎ, এবং মায়ের নাম গাত্রী তেরেসা কুবি। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।

বিশপ পনেন পল কুবি সিএসসি্র শৈশব কেটেছে বন-জঙ্গলে ঘেরা দেওয়াচালা গ্রামে। ঘর থেকে বেরুলেই দেখা মিলত বনের নানা রকম পশুপাখি ও জংলি শুকরের।

স্কুলে ভর্তি হন ১০ কি ১২ বছর বয়সে। আশপাশের গ্রামে স্কুল ছিল না। দেওয়াচালা গ্রাম থেকে ৩ কিঃ দূরে বিন্যাকুড়িতে স্কুল ছিল। সেখানেই তিনি ১ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। বিন্যাকুড়ি স্কুলে এক বছর পড়াশোনা করে শোলাকুড়ি স্কুলে ভর্তি হন ২য় শ্রেণিতে। শোলাকুড়ি স্কুলে এক বছর পড়ে ৩য় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলে তিনি ভর্তি হন নিজ গ্রামের স্কুলে। প্রয়াত যোগেশ মৃ তার শোলাকুড়ি স্কুলে পড়াকালীন সময়েই দেওয়াচালা গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যোগেশ মৃ এক সময় চলে যান । এরপর যোগেশ মৃর পরিবর্তে শিক্ষকতা করতে আসেন নিশিকান্ত মাঝি(প্রয়াত)। নিশিকান্ত মাঝি দেখলেন পড়াশোনায় বিশপ পনেন পল কুবি সিএসসি বেশ মেধাবী, তাই তাঁকে ৩য় শ্রেণি থেকে ৪তুর্থ শ্রেণিতে প্রমোশন দিয়ে দেন।

লেখাপড়ায় তাঁর উৎসাহ দেখে তাঁর বড় মা শান্তি কুবি খাতা-কলম কিনে দিতেন। নিজ গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে তিনি জলছত্র কর্পোস খ্রিস্টি জুনিয়র স্কুলে ভর্তি হন। তখন জলছত্র কর্পোস খ্রিস্টি জুনিয়র স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মিঃ জগদীশ বর্মন।

তিনি মধুপুর রাণী ভবানী স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। পড়াশোনার সময় তিনি প্রায়ই অসুস্থ্য থাকতেন। একবার তাঁর এমন অসুখ হলো তাঁর মাথার চুল পড়ে গিয়েছিল। তখন ফাদার হোমরিক ও সিস্টার ব্রনোর সহায়তায় তাঁকে মির্জাপুর হাসপাতালে ভর্তি করে তাঁর চিকিৎসা করা হয়।

মেট্রিক পাশ করার পর তিনি ফাদার হোমরিক ও সিস্টার জসিন্টা ম্রং এর অনুপ্রেরণায় ১৯৭৬ খ্রিঃ বান্দুরা সেমিনারিতে যোগদান করেন। এবং নটরডাম কলেজে ভর্তি হন। নটরডাম কলেজ থেকেই এইচএসসি ও ডিগ্রি পাশ করেন।

ফাদার হোমরিক ও সিস্টার জসিন্টা ম্রং এর অনুপ্রেরণায় তিনি যখন সেমিনারিতে গেলেন ফাদার হওয়ার জন্য, দেখলেন অভিভাবকদের মধ্যে অনুপ্রেরণা দেবার মতো চেতনাবোধ অতোটা ছিল না।সে সময় তিনি অনেককেই দেখেছেন , মান্দিরা যায় সেমিনারিতে ফাদার হবার জন্যে, কিন্তু সবাই ফিরে আসে। এমনকি পড়াশোনাও শেষ করতে পারতো না। বিষয়টা তাঁকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। তাঁর মনে হলো- কী আছে এই সেমিনারি জীবনে, কেন সবাই ফিরে চলে আসে ! এসব নানান জিজ্ঞাসা তাঁকে উৎসুক করে তোলে। তিনি ভাবলেন যে, আমি গিয়ে চেষ্টা করে দেখবো, দেখি পারি কিনা। তাঁর ব্রতীয় জীবনে যাওয়াকে তিনি একরকম চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলেন। সেমিনারিতে তখন আদিবাসী ছাত্রদের জন্য ভাষাটা একটা সমস্যা ছিল। অনেকে বুঝত কিন্তু ভালোমত প্রকাশ করতে পারতো না। তিনি নিয়মিত পড়াশোনা করে ও নিয়মিত ভাষা চর্চা করে এ সীমাবদ্ধতা থেকে কাটিয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর ব্রতীয় জীবনে তাঁর শিক্ষক ও পরিচালকদের কাছ থেকে অনেক বিষয়ে গঠন পেয়েছেন। নিয়মানুবর্তিতা, সময় ব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন ও পরিচালনা, প্রকাশনার কাজ, সৃষ্টিশীলতা এবং আধ্যাত্মিকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি পরিচালকদের মাধ্যমে শিখেছেন।

তিনি যেদিন যাজক হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছিলেন, দিনটি বিশেষত্বপূর্ণ এ কারণে যে , একসাথে ১৮ জন ফাদার প্রায় আশি হাজার মানুষের উপস্থিতিতে এরশাদ স্টেডিয়ামে পোপ দ্বিতীয় জন পলের কাছে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিল ময়মনসিংহ, দিনাজপুর ও সিলেটের আদিবাসীরাও।

পুরোহিত হবার পর তিনি প্রথম কাজ করেন ময়মনসিংহের মরিয়মনগর মিশনে। ১৯৮৬-১৯৮৯ পর্যন্ত। এরপর ১৯৮৯-১৯৯০ পর্যন্ত বিড়ইডাকুনি মিশনে কাজ করেন। ১৯৯০ সালে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারত চলে যান। ১৯৯০ সালেই জলছত্রে সেমিনারি গঠনের প্রস্তুতি শুরু করেন। তিনি বলেন, জলছত্র সেমিনারি গড়তে তাঁদের অনেম কষ্ট করতে হয়েছে। অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। এসকল কষ্ট ও চ্যালেঞ্জের ভিতর ছিল আনন্দ, ছিল প্রাপ্তি। প্রথম দুটি ব্যাচের কেউ ফাদার হতে পারে নি। কিন্তু তারা সবাই ছিল ভালো ছাত্র, ভালো গঠন পেয়ে ভালো মানুষ হয়ে গড়ে উঠেছে এবং এখন সমাজে তারা প্রতিষ্ঠিত। প্রথম দুটি ব্যাচের সেই সকল ছেলেদের নিয়ে তিনি একটি ফোরাম গঠন করেছেন। এর উদ্দেশ্য হলো-যাতে তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি পায় এবং তাঁদের সুন্দর চিন্তা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার দ্বারা যেন তারা সমাজকে কিছু দিতে পারে তার ভিত্তি গড়ে তোলা।

১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে মধুপুরের জলছত্র শান্তিনিকেতনে প্রাথমিকভাবে জলছত্র জলছত্র সেমিনারি শুরু করেন। ১৯৯২ সালে জলছত্র সেমিনারির নতুন ভবন তৈরি ও নতুন ভবনে সেমিনারি স্থানান্তর করেন।১৯৯১-১৯৯৪ খ্রিঃ পর্যন্ত জলছত্র সেমিনারিতে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪-১৯৯৫ পর্যন্ত রাণীখং মিশনে সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি ১৯৯৫-১৯৯৭ পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার জন্য ফিলিপাইনে যান এবং গঠনের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৯৭-১৯৯৯ পর্যন্ত নটরডেম সেমিনারিতে পরিচালক পদে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৩ খ্রিঃ পর্যন্ত রামপুর সেমিনারিতে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ খ্রিঃ ২৫ ডিসেম্বর রাতে ভ্যাটিকান সিটি কর্তৃক তাঁকে বিশপ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ্য, তিনি হলেন, বিশ্বের প্রথম মান্দি আদিবাসী বিশপ। 



বিশেষ করে হা’বিমার মান্দিদের মধ্যে প্রথম ফাদারই পরবর্তীতে বিশপ হিসেবে ঈশ্বর কর্তৃক মনোনীত হলেন। ২০০৪ খ্রিঃ ১৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর বিশপ হিসেবে অভিষেক হয়। ২০০৬ খ্রিঃ ১ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ ডায়োসিসের তিনি বিশপ হিসেবে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং অদ্যাবদি সদাহাসোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত ও বিনয়ী বিশপ পনেন পল কুবি সিএসসি নিষ্ঠার সাথে এ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।


-বচন নকরেক