বীর মুক্তিযোদ্ধা সমরাজ রিছিল

লেখকঃ ফাদার গৌরব জি. পাথাং

ফাদার গৌরব জি. পাথাং
একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা সমরাজ মারাক ওরফে সম্রাট রিছিল (লাল মুক্তিবার্তা নং-০১১৫১০০০০২) ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার গোবরা কুড়া গ্রামের নিবাসী।
তার জন্ম ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি। তার পিতার নাম মইনাদি চিসিম ও মাতা বিদ্যামনি রিছিল। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে গোবরাকুড়া গ্রামের সাখিনাথ পাথাং, পুলক রাংসা, কাজল সাংমা, প্রদীপ তজু, ভুটিয়াপাড়া গ্রামের উইলসন চিরান, ধলাপানি গ্রামের কার্নেশ চিসিম, হার্ডসন সাংমা, দিপসন সাংমা, কালিয়ানীকান্দা গ্রামের ম্যানুয়েল চিগিচাক, ভুবনকুড়া গ্রামের সরচরণ সাংমার সঙ্গে তিনি দুমনিকুড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রংরা ক্যাম্পে যান। সেখান থেকে বাঘমারা ক্যাম্পে এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রিক্রুট হয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলার ১৩ কিমি দক্ষিণে রংনাবাগ নামক ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নেন। এক মাসের প্রশিক্ষণে তিনি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, টু-ইঞ্চি মর্টার, এলএমজি, এসএমজি, এসএলআর, গ্রেনেড চার্জ ইত্যাদি চালানোর কলাকৌশল ও দক্ষতা অর্জন করেন। পরে তিনি তিন দিনের জঙ্গল ট্রেনিং নেন। ট্রেনিং শেষে তিনি ‘নাজমুল কোম্পানি’তে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ময়মনসিংহ জেলার নকলা, তেলেখালি, কড়ইতলা, বান্দরকাঁটা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কোমান্ডার কর্নেল আবু তাহের। তার ৩নং কোম্পনিতে কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন নাজমুল হক। নাজমুল হকের মৃত্যুর পর ডাঃ উইলিয়াম ¤্রং এই কোম্পনির দায়িত্ব নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি উইলিয়াম কোম্পানির একজন ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তারা বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী শিবির স্থাপন করে যুদ্ধ করতেন। ভারত বাংলাদেশ বর্ডারে গাছুয়াপাড়া বিএসএফ ক্যাম্প থেকে যুদ্ধ করতেন। একদিন বিএসএফ কমান্ডার ক্যাপ্টিন বাজিৎ সিং নিদের্শ দিলেন কড়ইতলী পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করার জন্য। তাই সূর্য অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন। কিন্তু তাদের আগেই পাকবাহিনীরা তাদের ক্যাম্প আক্রমণ করতে লাগল। শুরু হলো দুই পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময়। রাত বারোটার দিকে ক্যাপ্টেন বাজিৎ সিং ঢালু থানা থেকে গাড়িতে নিয়ে এলেন এলএমজি। তারপর শুরু হলো জীবন মরণ যুদ্ধ। সেই দিন ভোরে যুদ্ধ থেমেছিল।



কাটাখালি সেতু যুদ্ধ ॥ সমরাজ রিছিল ও তার সহযোদ্ধারা ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর মহকুমা (বর্তমানে জেল) সদর হতে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরত্বে নালিতাবাড়ি থানার পূর্বদিকে ভোগাই নদীর ওপর কাটাখালি সেতু ও পশ্চিমে তিন আনি ফেরিঘাট বিদ্যমান। এই কাটাখালি সেতু ও তিন আনি ফেরিঘাট সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ দক্ষিণে নকলা থানা, পূর্বে হালুয়াঘাট ও ফুলপুর থানা, উত্তরে ভারত সীমান্ত। তাই বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত অনেক বিওপির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের জন্য এই সেতু ও ফেরিঘাট ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এটি ছিল ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অপারেশনাল এরিয়া, যার হেড কোয়ার্টার ছিল ময়মনসিংহে। এখানে ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্যের অবস্থান ছিল। সেই সঙ্গে রেঞ্জার্স ও রাজাকার বাহিনীর একটি করে কোম্পানি নিয়োজিত ছিল। হানাদার বাহিনী রাস্তার চলাচল নিরাপদ রাখার জন্য ফেরিঘাট এবং সেতুতে নিয়মিত টহল দিত। এরপর তারা সন্ধ্যার আগেই হালুয়াঘাট ক্যাম্পে ফিরে যেত। সে সময় ১ প্লাটুন রাজাকার ফেরিঘাট ও সেতু নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করত। হানাদারদের এই যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে দেয়ার জন্য জুন মাসে ডালু সাব সেক্টর কমান্ডারের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়। ৪ জুলাই কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসানের নেতৃত্বে ৫৪ মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ডালু অপারেশন ক্যাম্প থেকে নালিতাবাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়। বৃষ্টির মধ্য দিয়ে দলটি বারোমারীর পশ্চিম দিক দিয়ে রাত একটায় নালিতাবাড়ির উত্তরে শিমুলতলী গ্রামে লুকিয়ে থাকে। নাজমুল আহসানের নির্দেশে দলটি দুইভাগে বিভক্ত হয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল গণির নেতৃত্বে ২৪ জনের একটি দলের ওপর দায়িত্ব পড়ে তিন আনি ফেরিঘাটের ফেরি ধ্বংস করার। বাকি ৩০ জনের দায়িত্ব থাকে কাটাখালি সেতু ধ্বংসের। যার নেতৃত্ব দেন নাজমুল আহসান। একই সময়ে দুইটি দল কাটাখালি ও তিন আনি ফেরিঘাটের দিকে রওনা দেন। প্রবলবষর্ণে কারণে তখন রাজাকাররা বাঙ্কারে অবস্থান করছিল। সেতু এলাকা পর্যবক্ষণের জন্য প্রথমে ২ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রেরণ করেন। তারা পর্যবেক্ষণে নিশ্চিত হন যে রাজাকাররা বাঙ্কারে আছে। পরে নাজমুল আহসানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কার আক্রমণ করেন এবং সেতু আক্রমণ করে তা ধ্বংস করেন। তাতে রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। অপরদিকে আবদুল গণির নেতৃত্বে তিন আনি ফেরিঘাট আক্রমণ করে ধ্বংস করেন। যুদ্ধ শেষে উভয় দলই রাঙ্গামাটি গ্রামে নাজমুল আহসানের বন্ধু নইমুদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন।



রাঙ্গামাটি যুদ্ধ ॥ মুক্তিযোদ্ধারা যখন নইমুদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছিলেন তখন একজন দালাল তাদের দেখে ফেলে। বিষয়টি মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারেনি। ৬ জুলাই হানাদার বাহিনী তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে পাহারায় 
নিয়োজিত ২ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে বিষয়টি জানান। মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতি নেয়ার আগেই হানাদার বাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করে। কমান্ডার নামজুল আহসান সহযোদ্ধাদের বিল সাঁতরে পাড় হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে নির্দেশ দেন। আর তিনি নিজে সহযোদ্ধাদের বাঁচানোর জন্য শক্রুর বিরুদ্ধে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। তার সাহসিকতায় সহমুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে যান এবং ডালু ক্যাম্পে নিরাপদে আশ্রয় নেন। কিন্তু তিনি গুলির আঘাতে শহীদ হন। তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার চাচাতো ভাইসহ আরেক মুক্তিযোদ্ধা বিল পাড় হওয়ার সময় গুলির আঘাতে সলিল সমাধি হন।



বান্দরকাটা বিওপি আক্রমণ ॥ বান্দরকাটা বিওপি ক্যাম্পটির অবস্থান হলো ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া থানার মাঝে। এটি ছিল হানাদার বাহিনীর ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অপারেশনাল এলাকা। এখানে তাদের এক প্লাটুন সৈন্যের অবস্থান ছিল। আর তাদের সহায়তায় ছিল স্থানীয় রাজাকারেরা। জুলাই মাসে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারেরা বাংলাদেশে যেন মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। তাই তারা সীমান্ত এলাকাগুলো কঠোরভাবে টহল দিতে থাকে। এ কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাভাবিক চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি হয়। তাই আগস্ট মাসের ৫ তারিখে রাত তিনটায় বান্দরকাটা বিওপি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই আক্রমণের নেতৃত্ব দেন ছাত্রনেতা আবুল হাসেম ও পুলিশের হাবিলদার জিয়াউদ্দিন। তারা দুটি দলে মোট ৪০ জন করে সহযোদ্ধা নিয়ে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীও তাদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বান্দরকাটা বিওপি আক্রমণ করে শত্রুর ১ নাম্বার ও ৫ নাম্বার বাঙ্কার দল করে নেন। এ সময় হঠাও বিওপির দক্ষিণে অবস্থিত দুটি বাঙ্কার থেকে হানাদার বাহিনী গুলিবর্ষণ করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ চালাতে থাকে। তাদের আক্রমণে হানাদার বাহিনীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।



হালুয়াঘাট যুদ্ধ ॥ তার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ও বিভিষিকাময় ঘটনা হলো ৬ ডিসেম্বর। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর যুদ্ধ ঘোষণার পর সমরাজ মারাক, সুকেন ও হরমুজ আলী এই তিনজনের দায়িত্ব ছিল মিত্রবাহিনীকে গাইড করা বা পথ দেখানো। প্রত্যেক মিত্রবাহিনীর গলায় ছিল আশীর্বাদিত মেডেল। যুদ্ধে নামার আগে বন্দে মাতরম উচ্চারণ করে তারা বাংলাদেশের মাটিতে নেমে পড়লেন। তারা হালুয়াঘাট থানার নয়াপাড়া গ্রামে এসে ব্যাংকার স্থাপন করলেন। সেখানে এসে তারা জানতে পারলেন হালুয়াঘাট থানার কাছে পাকবাহিনীর ক্যাম্প রয়েছে। তাই তারা তাদের বিরুদ্ধে থ্রি ইঞ্চি মর্টার ছুড়ে মারলেন। তারাও পাল্টা জবাব দেয়ার জন্য গুলি বর্ষণ করতে লাগল। এভাবে দুই দলের মধ্যে গুলি বিনিময় হতে লাগল। চারদিকে শুধু মর্টারের শব্দ শোনা গেল। তারপরও তারা যুদ্ধ করতে করতে মোজাখালি গ্রামে এসে পড়ল। তখনই ভারত থেকে তিনটি যুদ্ধ বিমান এসে পাকবাহিনীর উপর গুলিবর্ষণ করতে লাগল। তাদের গুলিবর্ষণে পাকবাহিনীরা পরাজিত হলো আর সেই দিনই শত্রুমুক্ত হলো হালুয়াঘাট থানা।



বীর মুক্তিযোদ্ধা সমরাজ রিছিল যুদ্ধশেষে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ ধোবাউড়া উপজেলার ঘিলাগড়া গ্রামের মতেন্দ্র রিছিল ও কিরণমনি পাথাং-এর কন্যা কবিতা পাথাংকে বিয়ে করেন এবং সেই গ্রামেই বসতি স্থাপন করেন। তার পরিবারে সাত ছেলে মেয়ে রয়েছে। তারা হলো-লিলিয়ান পাথাং, বর্ণালী পাথাং, গৌরব পাথাং, সতী পাথাং, লেহান পাথাং, থাংমি রিক্তা পাথাং, অম্লান পাথাং। তার ছেলে গৌরব পাথাং ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ১ ডিসেম্বর পুণ্য পিতা পোপ ফ্রান্সিস কর্তৃক রাজকীয় অভিষেক লাভ করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সমরাজ রিছিল