ফাদার ইউজিন ই হোমরিক সিএসসি

ফাদার ইউজিন ই হোমরিক সিএসসি


ফাদার ইউজিন ই হোমরিক সিএসসি
ফাদার ইউজিন ই হোমরিক সিএসসি
.
ফাদার ইউজিন ই  হোমরিক (৯১)সিএসসি ছিলেন একজন আমেরিকান যাজক। তিনি সুদীর্ঘ ৬১ বছর মিশনারি জীবন অতিবাহিত করে নিজ দেশ আমেরিকাতে চলে গেছেন। আমেরিকান ফাদার হোমরিক ছিলেন হা'বিমা অঞ্চলের মান্দিদের কাছে সবার প্রিয় একজন । তিনি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। সরকার তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সনদও দিয়েছে। তিনি পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা। জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হলিক্রশ পুরোহিত ফাদার হোমরিক পীরগাছা ধর্মপল্লী তথা হা'বিমা অঞ্চলের  মান্দিসহ সবার প্রাণপ্রিয় শিক্ষক, ধর্মগুরু ও পিতৃতুল্য অভিভাবক।মধুপুর জঙ্গলের অবহেলিত, দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত, শিক্ষা ও চিকিৎসাবঞ্চিত, ভাগ্যহত জনগোষ্ঠীর জন্য তার সমগ্র জীবন-যৌবন অতিবাহিত করে গেছেন তিনি। তমসাপীড়িত সমাজের বিবরে জ্বেলে গেলেন আলোর রোশনাই।

জার্মান পিতা বার্নার্ড হোমরিক ও অস্ট্রেলিয়ান মাতা ইলা ভেলির ঔরসে ১৯২৮ সালের ৮ ডিসেম্বর মানবদরদী ইউজিন ই. হোমরিকের জন্ম। তখন তার বাবা-মা থাকতেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান প্রভিন্সের মুসরিগন নামক স্থানে। ছয় ভাই বোনের মধ্যে চতুর্থ ইউজিন হোমরিক বহুবিদ বিষয়ে শিক্ষার্জন করে খ্রিস্ট ধর্মে ব্রত নিয়ে যাজক হন এবং বাংলাদেশে আসেন। ১৯৫৫ সালে বাংলাদেশে এসেই তিনি নটর ডেম কলেজের তৎকালীন বাংলার অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ আবদুল হামিদের কাছে বাংলা ভাষার পাঠ নেন।১৯৫৬ সাল থেকে ৩ বছর ঢাকার নবাবগঞ্জের গোল্লা ধর্মপল্লীতে কাজ করে ময়মনসিংহ শহর ও হালুয়াঘাটে বদলি হন। হালুয়াঘাটের বিড়ইডাকুনিতে ৯ মাস থেকে ১৯৬০ সালে চলে আসেন টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চলে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ধর্মসহ অনেক বিষয়ে সবাইকে সচেতন করতে তিনি আন্তরিকভাবে কাজ করেছেন। জলছত্র মিশনের দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি উপলব্ধি করেন, অশিক্ষা ও দারিদ্র্য মান্দি আদিবাসীদের নিত্যসঙ্গী। তাদের ঘরে সারা বছর খাবার থাকে না, তারা রোগেশোকে সর্বদাই জর্জরিত ও শিক্ষার আলো থেকে  বঞ্চিত। বিশুদ্ধ পানীয় জলের সুবিধা নেই ও স্যানিটেশনের সুযোগ-সুবিধা নেই। তাই তিনি পিছিয়ে থাকা এই মান্দি জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে তোলেন ৩৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। জলছত্র এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন কর্পোস খ্রিস্টি উচ্চ বিদ্যালয় এবং পীরগাছায় প্রতিষ্ঠা করেন সেন্ট পৌলস উচ্চ বিদ্যালয়। মান্দি ছেলেদের জন্য দুটি ছাত্রাবাস ও মান্দি মেয়েদের জন্য দুটি ছাত্রীনিবাস স্থাপন করেন। আদিবাসী মান্দি সম্প্রদায়ের বিশুদ্ধ পানির অভাব দূরীকরণে তিনি কূপ, নলকূপ ও গভীর নলকূপ স্থাপন করেন। তাদের আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির সংস্পর্শে নিয়ে আসার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে কৃষিবিদদের মাধ্যমে মান্দি সম্প্রদায়ের জন্য কৃষি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তিনি নিজেও কৃষি ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেছেন। জলছত্র অঞ্চল আদিবাসী মান্দি সম্প্রদায়ের জন্য জীবনযাত্রা কিছুটা সহজ করে গড়ে তুলে তিনি ১৯৯২ সালে মধুপুর জঙ্গলের আরো গভীরে পীরগাছা নামক স্থানে এসে নতুন মিশন স্থাপন করেন। তখন শোলাকুড়ী ইউনিয়নের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে না ছিল কোনো পাকা রাস্তাঘাট, না ছিল বিদ্যুৎ সংযোগ।

যাজকীয় জীবনের ৫০ বছরে ২০১৫ সালের ৩০ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ওয়ানগালায় তাঁকে বিশেষ কৃতজ্ঞতায় অভিনন্দিত করেন আদিবাসী মান্দি সম্প্রদায়। ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর একই অনুষ্ঠানে দেয়া হয় হীরকজয়ন্তীর অভিনন্দন। উভয় অনুষ্ঠানে হোমরিকের শেষদিন পর্যন্ত মান্দি সম্প্রদায়ের সাথে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে নিজ দেশে ফিরে যেতেই হয়। বয়স আর সাম্প্রতিক নিরাপত্তাজনিত সমস্যা তাঁকে তাঁর প্রিয় মান্দিভাইদের ছেড়ে চলে যেতে হয়।

বন বিভাগ ঘন ঘন মান্দিদের গড়াঞ্চল থেকে উচ্ছেদের পায়তারা করত। তিনি পরেশ মৃ-কে দিয়ে এলাকার মান্দিদের সংঘব্ধ করান প্রতিবাদ করান। নিজে বিভিন্ন জায়গায় চিঠি লিখেন মান্দিদের স্বত্ব দখলীয় জমিতে/বসতভিটায় বনায়ন প্রকল্পের বিরুদ্ধে।বন বিভাগের গড়াঞ্চল থেকে অনত্র উচ্ছেদ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তিনি মান্দি ও মান্দাই আদিবাসী সম্প্রদায়ের পাশে থেকেছেন লিগ্যাল এইড সহায়তার জন্য ব্যবস্থা করেছেন। 

তিনি মান্দি সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য বিষেষ অবদান রেখে গেছেন। নিজে ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক নিষ্ঠ পাঠক তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে বঙ্কিম, মানিক, শরত পড়েছেন । মান্দি ভাষায় মিশা পরিচালনা করাতেন। মান্দি গান চলাকালীন আদুরী, দামা, নাগ্রা বেজে উঠত। পীরগাছায় মিশন প্রতিষ্ঠার পর তিনি প্রতিবছর মান্দি জাতির বড় উৎসবওয়ান্‌গালাউদযাপন করেন। তিনি বলতেন নিজের সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে হবে। তোমাদের সংস্কৃতি খুব সুন্দর। সুভাষ জেংচামগারো আইনবইটি লেখার জন্য তাঁর দ্বারাই অনুপ্রাণীত হন। তাঁর হাত ধরে অসংখ্য কৃতী সন্তান গড়ে উঠেছে। যারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আলোর বিকিরণ ছড়াচ্ছেন। মূলত গড়াঞ্চলের মান্দিরা ভুলবে না তাঁর অনন্য অবদানের কথা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য-র পাশাপাশি তিনি অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনেও  ছায়ার মতো নিরীহ আদিবাসীদের পাশে ছিলেন। 


No comments:

Post a Comment