-বচন নকরেক
১… দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
হে-দুর্গম পথের যাত্রীদের এ হুশিয়ারী স্বয়ং নজরুল শুনিয়েছিলেন। নদী-বন-পাহাড়
দুর্গম মরুকান্তার অতিক্রম করে আমাদের রূপ আজ গুঙুর মুখর। পায়ে হেঁটে, উটের পিঠে,
ঘোড়ার পিঠে কোন বাহনে করে আমরা এতদূর এলাম, প্রশ্ন করতে পারি। ১০০ বছরে মন্ডলীর
অর্জন (Achievement) , লোকসান কতোটুকু একজন খ্রিস্টান হিসেবে এর হিসেব-নিকেশ কষতে
বসলে হারানোর পাল্লাটাও কম নয়। আয়নায় দাঁড়ালে বোঝা যাবে শত বছর বয়েসী
বৃক্ষমন্ডলীকে এর আসলরূপে। ইংরেজিতে একটা কথা প্রচলিত আছে- Culture is the mirror
of a nation. অর্থাৎ, সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির দর্পণস্বরূপ। কোন জাতির আসল পরিচয়
তার সংস্কৃতিতে(দাক্বেওয়াল)। তার সংস্কৃতিই বলে দেবে সে কোন জাতির বা গোত্রের
মানুষ। তাই, এই আমাদের ভঙ্গুর দর্পণ তূল্য সংস্কৃতির ভেতর নিজেদের ভালোমতো অবলোকন
করে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, ঠিক করে নেয়া দরকার মান্দি/আ’চিক খ্রিস্টান হিসেবে
আগামীর ইতিহাসের মহাসড়কে আমাদের যাত্রারম্ভ কেমন হওয়া দরকার তা। আ’চিক/মান্দি
অধ্যুষিত এলাকার খ্রিস্টান মন্ডলীগুলো শতবর্ষ বার্ষিকী উদ্যাপন করছে। । আর তাদের
এ উদযাপনের দিন থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে নতুন করে পথচলা নতুন দিগন্তের দিকে। আরো
নতুন শতবর্ষ, দুর্গম গিরি-কান্তার মরুর দিকে। থামার সুযোগ নেই, সামনে অনন্ত পথ,
পঙ্কিল পাঁক-ভরা এ যাত্রা।
২... মাতৃসূত্রীয় মান্দি/আ’চিক সমাজের সংস্কৃতি
, রীতিনীতি, ধ্যাণ-ধারণা, প্রথা-পদ্ধতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, অনুপম ও অদ্বিতীয়।
বিরল সে-সব সংস্কৃতির উপাদানগুলো যে কোন কারণেই হোক বর্তমান মান্দিদের যাপিত জীবন
থেকে অনেকটাই উঠে গেছে। আজকে যেরকম মান্দি মূল্যবোধ, বৈশিষ্ট্য নিয়ে মান্দি
খ্রিন্টানরা শতবর্ষ উদ্যাপন করছে , যেন আরো ১০০ শত বছর পর তথা দ্বি-শত বছরের
অভিযাত্রায়ও খ্রিস্টান মান্দিরা আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল হয়েই সড়কের শেষ প্রান্তে
পৌঁছতে পারে। এরজন্য যে মান্দি সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো খ্রিস্টান মান্দিদের
দৈনন্দিন অভ্যাস্ত জীবনে পুনঃপ্রচলনযোগ্য (Revive able) সেসব প্রচলন করা আবশ্যক।
এক, দুই, তিন---করে নতুন শতকে পৌঁছে নতুন প্রজন্মের মান্দিরা(গারো) যেন বলতে পারে,
আমরা ‘মান্দি’ , আমরা মান্দিদের যুগ লালিত ঐতিহ্য , সংস্কৃতি, ভাষা, মূল্যবোধ, ধরে
রেখেছি(ধারক, বাহক হয়ে)। কিন্তু, সে সময়ে মান্দিরা যদি নিজেদের মিশ্র জাতি(শংকর)
মিশ্র সংস্কৃতির ভিতর হারিয়ে ফেলে , নিজেদের মান্দি জাতি হিসেবে চিনতে না পারে, এর
দায় কী বর্তমান খ্রিস্টান মন্ডলীর থিঙ্ক-ট্যাঙ্কদের উপর বর্তাবেনা?
৩…অবশ্য, খ্রিস্টানমন্ডলীসমূহকে অনেক চড়াই-উৎরাই, ভাঙাগড়ার মুখোমুখী হতে হয়েছে বিগত দিনগুলোতে। দীর্ঘ বৃটিশ শাসন-শোষণ, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ, ৬৪/৬৪ তে সাম্প্রদায়িক দাঙা, ভারতে পলায়ন, পাকিস্তান আমল ...৭১’এ স্বাধীনতা যুদ্ধ, ভারতে পলায়ন, ফিরে এসে চাষের জমি, ভিটেবাড়ি, মাছের পুকুর, হালের গরু কিছু না ফিরে পাওয়া এবং ৭৫’ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদে বিতর্কিত কাদেরীয় বাহিনী গঠন এবং মান্দি যুবকের অংশগ্রহণ ও মৃত্যুবরণ বলতে গেলে অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির থাবায় বিভিন্ন রকম নির্যাতন-নিপিড়ন, বৈষম্য, অবহেলা ও অন্যায্যতার শিকার হতে হয়েছে। প্রবল প্রতাপশালী সংস্কৃতিক শক্তির আগ্রাসনেরও শিকার হচ্ছে আমাদের মতো শতশত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বহু সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্য। বিপন্ন প্রজাতি হয়ে অনেক ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীকে টিকে থাকার নিরন্তর লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হচ্ছে।
৩…অবশ্য, খ্রিস্টানমন্ডলীসমূহকে অনেক চড়াই-উৎরাই, ভাঙাগড়ার মুখোমুখী হতে হয়েছে বিগত দিনগুলোতে। দীর্ঘ বৃটিশ শাসন-শোষণ, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ, ৬৪/৬৪ তে সাম্প্রদায়িক দাঙা, ভারতে পলায়ন, পাকিস্তান আমল ...৭১’এ স্বাধীনতা যুদ্ধ, ভারতে পলায়ন, ফিরে এসে চাষের জমি, ভিটেবাড়ি, মাছের পুকুর, হালের গরু কিছু না ফিরে পাওয়া এবং ৭৫’ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদে বিতর্কিত কাদেরীয় বাহিনী গঠন এবং মান্দি যুবকের অংশগ্রহণ ও মৃত্যুবরণ বলতে গেলে অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির থাবায় বিভিন্ন রকম নির্যাতন-নিপিড়ন, বৈষম্য, অবহেলা ও অন্যায্যতার শিকার হতে হয়েছে। প্রবল প্রতাপশালী সংস্কৃতিক শক্তির আগ্রাসনেরও শিকার হচ্ছে আমাদের মতো শতশত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বহু সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্য। বিপন্ন প্রজাতি হয়ে অনেক ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীকে টিকে থাকার নিরন্তর লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হচ্ছে।
৪...বলেছিলাম আয়নায় মুখ দেখার কথা। কিন্তু, আমরা
ভঙ্গুর আয়না যত্নে রাখিনি। কাচের আয়নার মতো যত্নের সাথে ব্যবহার করা না হলে ভেঙে
যায় নষ্ট হয়ে যায় সংস্কৃতির দর্পণও । সংস্কৃতিও কাচের মতই ভাঙনপ্রবণ। তাই, অনেকটাই
দর্পণস্বরুপ আমাদের সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে আমাদেরই অবহেলার কারণে। তাই, এখন যা আছে
তা হচ্ছে কেবল বিদীর্ণ দর্পনে মুখ দেখার মতো। তারপরও দেখতে হচ্ছে ভাঙা আয়নায় মুখ।
৯৯% মান্দি এখন খ্রিস্টান। বিভিন্ন দলে বিভক্ত খ্রিস্টিয়ানিটির ভেতরে নিজেদের
মান্দিত্ব হারিয়ে ফেললে চলবে না। মনে রাখতে হবে, খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হলেও
আমরা ‘মান্দি/আ’চিক’। এবং এটাই আমাদের বড় পরিচয়। আমাদের আছে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি,
সুর-সংগীত, লোক-সাহিত্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, আলাদা খাদ্যাভ্যাস, সঙ্গীতযন্ত্র,
ব্যাবহার্য সামগ্রী। আছে সততা, বিশ্বাস, আলাদা মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা,
প্রথাপদ্ধতি। তাই, মান্দি/আ’চিক খ্রিস্টান মন্ডলীতে মান্দি দাক্বেওয়ালগুলো
অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে সংস্কৃত্যায়ন প্রয়োজন। এর ফলে খ্রিস্টান মান্দি/আ’চিকদের
জীবন আরো পরিপূর্ণ হবে। ঈশ্বরের পথে মান্দি/আ’চিকদের পথচলা হবে আরো গতিশীল।
মন্ত্রপূত জলের মতো হবে আশির্বাদস্বরুপ। না হলে মান্দি/আ’চিক জাতিসত্তা হিসেবে মুখ
দেখে নিজেদের চেনার জন্যে দর্পণতুল্য সেই সংস্কৃতির সামান্যটুকুও আর থাকবে না।
৫...শুরুতে বলেছিলাম বাহনের কথাও। পায়ে হেঁটে ,
উটের পিঠে, ঘোড়ার পিঠে__কোন বাহনে সওয়ার হয়ে আমাদের অভিযাত্রা! মূলতঃ গারো
ব্যাপ্টিস্ট কনভেনশন(G.B.C), চার্চ অব বাংলাদেশ, এস, ডি, এ চার্চ এবং রোমান
ক্যাথলিক নামক বাহনে সওয়ার হয়ে মান্দি/আ’চিক খ্রিস্টানরা এগুচ্ছে দ্বি-শতকের দিকে।
G.B,C অনেক আগেই তাদের মন্ডলীর ১০০ বছরেরর মাইলফলক স্পর্শ করেছে। চার্চ অব
বাংলাদেশ ও রোমান ক্যাথলিক প্রায় একই সময়ে এ লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছে প্রায় সব
মান্দি/আ’চিকদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারার সফলতার
মাধ্যমে(মান্দি/আ’চিকরা এখন ৯৯% খ্রিঃ)। বিরল ও অনিন্দ্যসুন্দর সংস্কৃতির অধিকারী
মান্দি/আ’চিকরা তাদের হাজার বছরের পুরানো বাহন ‘সাংসারেক’ পরিত্যাগ করে ঐ যে তারা
নতুন বাহনে সওয়ার হয়েছিল, তা সঠিক ছিল কী না নতুন প্রজন্মের মান্দিদের কারো কারো
মনে এ নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে। এবং উল্লেখিত বাহনসমূহের নিজেরা চালক হয়ে যুগযুগ
লালিত আপন মান্দি মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, লোকাচার ধরে রাখার
চেষ্টা না করলে আগামীতে এরকম দ্বি-শত বছর উদ্যাপনের দিনে মান্দিরা তাদের আদলগত,
ভাষাগত, ঐতিহ্যগত, সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্যের স্বাতন্ত্রতা নিয়ে হাজির হতে পারবে কী
না __এ নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
৬...বর্তমান যুগ প্রতিযোগিতার যুগ। বিশ্বের
ক্ষমতাশালী ইংরেজ জাতিরা তাদের ইংরেজি ভাষাকে শিখতে বাধ্য করছে প্রযুক্তির সাহায্য
নিয়ে। Mobile শব্দটা একজন অশিক্ষিত ব্যক্তি যতনা সহজে বুঝবে, তা-ই বাংলায় মুঠোফোন
বললে বুঝবেই না। এভাবে Call, miscall, flex load ইত্যাদি শব্দগুলো বহুদিনের চেনা
অভ্যাস্ত শব্দের মতো আপন হয়ে গেছে। মোদ্দাকথা, অনলাইন সংস্কৃতির কু-প্রভাব লেগেছে
সব ভাষাতেই। তাই, নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে চাইলে এর ব্যাপক চর্চার
প্রয়োজন। সুসুমি, রিম্মিৎ, জা’দিল, চাদাম্বে, আ’চিক…এরকম মান্দি/আ’চিক শব্দ দিয়ে
নিজেদের সন্তানের বা আমাদের তৈরি প্রতিষ্ঠান/সংগঠনের
নামাকরণ মান্দি/আ’চিক শব্দে রাখা প্রয়োজন। নিজেদের সন্তান, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন,
সভা-সমিতির নাম নিজ ভাষায় রাখলে তা অজান্তেই চেতনার দরোজায় কড়াঘাত করবে প্রতিনিয়ত।
মান্দি/আ’চিক অধ্যুষিত এলাকায় চার্চ পরিচালিত স্কুলগুলোতে মান্দি/আ’চিক ভাষা
শিক্ষার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। যাতে আজকের মান্দি/আ’চিক শিশুরা সমৃদ্ধ
মান্দি/আ’চিক ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়ে এগিয়ে যেতে পারে প্রজন্মের পর
প্রজন্ম।
৭…দুঃখজনক যে , আমাদের নিজস্ব বর্ণমালা নেই।
রোমান হরফেই আমাদের মান্দি ভাষা লিখতে ও পড়তে হচ্ছে। এ পর্যন্ত খোদ বাংলাদেশেই ৫
জন মান্দি/আ’চিক বর্ণমালার আবিস্কারকের নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন-জন থুসিন রিছিল,
ডানিয়েল রুরাম, মার্টিন রেমা, প্রদীপ মানখিন ও অরুন রিছিল। এভাবে শুধু শুধু
বর্ণমালা আবিস্কার করা শুরু করলে তো আগামী কয়েক বছরে বর্ণমালা আবিস্কারকের সংখ্যা
একশ’তে পৌঁছে যাবে!! কিন্তু, কাজের কাজ কিছু হবে না। ধরো, এরকম দেখাদেখি আমিও একটা
তৈরি করলাম (থক্বিরিম)…। আমার নামও ফুটলো থক্বিরিম আবিস্কারকের খাতায়। কিন্তু,
কী লাভ হবে তাতে। মেঘালয়ের মান্দিরা আমাদের থক্বিরিম স্বীকৃতি দিবে না। কোন জাতির
সংস্কৃতির প্রধান উপাদান হচ্ছে ভাষা। তাই ভাষার নিবিড় যত্ন ও পরিচর্চার প্রয়োজন ।
কারণ, ভাষাই পারে সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদানকেও নেতৃত্ব দিয়ে সামনের দিকে নিয়ে
যেতে।
৮…আগামী দিনগুলোতে মান্দি/আ’চিক জাতির অস্তিত্ব
ধরে রাখার জন্যে উল্লেখিত বাহনগুলোকে পরস্পরের মধ্যে সংহতি ও ঐক্য ধরে রাখার জন্যে
বিভেধ এড়িয়ে চলতে হবে। খ্রিস্টানতার রকমফেরের কারণে বহুধা বিভক্ত আমাদের সমাজ। যেন
একই পরিবারে ৪ ভাই-একজন ব্যাপ্টিস্ট, অন্যজন চার্চ অব বাংলাদেশ, আরেকজন ক্যাথলিক,
শেষেরজন শনিবাইরা। একই মায়ের সন্তান হয়েও একসাথে প্রার্থনায় বসে না। মান্দি/আ’চিক
হলে, ছেলে বা মেয়ে যে চার্চেরই হোক, বিয়ের অনুমতি দেয়া দরকার। কে ক্যাথলিক, কে
ব্যাপ্টিস্ট তা বড় কথা নয়, সেই ছেলে বা মেয়ে একজন মান্দি/আ’চিক…তা-ই গুরুত্বপূর্ণ।
বরং ধর্ম এক হলেও ভিন জাতির ছেলের সাথে বিবাহের ক্ষেত্রে অনুৎসাহিত করা দরকার। এইসব
বিষয় নিয়ে আন্তঃমান্ডলিক সংলাপকে জোর দিতে হবে। সম্মিলিত পথ চলার মধ্য দিয়েই
মান্দিদের অস্তিত্ব আগামী দ্বি-শতকে পৌঁছেও অক্ষত থাকবে বলে আশা রাখি। এভাবে আশার
মশাল জ্বালিয়ে ঘুমভাঙা পথ ধরে …মান্দি/আ’চিক পরিচয়ে যেন ছুঁতে পারি আরো শত শত
শতক(সেঞ্চুরি)।
No comments:
Post a Comment