নিশি লীলা



নিশি লীলা
-বচন নকরেক
খুব ভোরে গরাঙ্গর ফার্মেসিতে মাখন কাটা মাথায় ব্যান্ডজ নিতে আসে। আশপাশের চা স্টলে বসে থাকা দুএকজন জড়ো হয়। নানা জন নানা মন্তব্য করে ।

একজন বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে,
-
নটি মাগি, এক স্বামী খাইসে, আইস্কা আবার আরেক স্বামীরে থুইয়া লুচ্চা দ্বিগীনের লগে পলাইয়া গেসে গা। তাও মাথায় আঘাত কইরা । গরাঙ্গ ব্যাণ্ডেজ বাঁধা শেষ হলে মাখনকে ঔষধ দেয়। কারোর সাথে কোন কথা না বলে চুপচাপ বাড়ির দিকে চলে যায় মাখন। মাখনের পাশের বাড়ির চেঙ্গু বিড়ি কিনতে আসে দোকানে। তাকে ঘিরে ধরে সবাই জানতে চায়,- ঘটনা কী ? চেঙ্গু বলে-মাগিডার দ্বিগীনের লগে পরথম স্বামী নকুল থাকতেই ভাব আসিল, আরো কার কার লগে আসিল, জানি না , মাখনের লগেও আসিল। শেষেতো নকুল মরার পর মাখনের লগে হাঙ্গা বিয়া করে। একটা বাচ্চা অয়। এহন থুইয়া—– দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে থাকা লোকগুলো বলে উঠে-ছি:ছি:ছি;ছি:।

মান্দিরা শিক্ষত অইয়া অহন বড় বড় চাকুরি করে। আমরাও খ্রিস্টান অইলে পড়াশুনায় আগাইতাম। আরো ভাত দেও।-নাইক্যা, খালি তুই খাবি ? পুলাইপান খাই নাই। আমিও খাই নাই।
- আমার পেট ভরে নাই যে।
-হু, কাম না করলে ভাত আব কোন থিকা।মান্দি বাড়ি কাম কইরা সারা বছর তোমারে খাওয়াইতাসি। বড়ঁশি নিয়া ঘর থিকা রোজ বাইর অও ফিরো রাত কইরা, মান্দি বাড়ি মদ খাইয়া মাতাল অইয়া। মাখন বর্মণ না শোনার ভান করে হাত ধোয় আর গান গায়-ছি:ছি;ছি;ছি: লইজ্জায় মরি একই তোমার ব্যবহার।
তুলসী গলা ছড়িয়ে বলে-গানতো অয়না, ছাগল ভ্যাবানি। অইযে কয় না, মাইনসের স্বামী গান গায় মধুরবাণী, আমার স্বামী গান গায় ছাগল ভ্যাবানি ।
- ধ্যাৎতেরী, ভাতও পেট ভইরা দিলি না, গান গাইলেও কুটা মার। যা, খালে যামুগা। মনে অয় আইজ মাছ পামো, ভালা স্বপ্ন দ্যাখসি।
-পাইলেও কি অ, বেইচ্যা চা-বিড়ি খাইয়াই শেষ করবা। বাড়িতে অইনাতো খাওয়াবা না কোনদিন ।
-ধ্যাৎতেরী, তুই কামে যাগা, প্যাচাল পারিস না। আইস্কা ঠিকই মাছ পামু। বাড়িতে নিয়াও আমু স্বপ্নে মেলা মাছ ধরসি।

গজাড়িগড়া গ্রামের মান্দাই পাড়ার মান্দাইরা কেউ নাস্তা পানি না খেয়েই, কেউ খেয়ে নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে লাল কাকড়ের সরু রাস্তা ধরে। কারো হাতে কাচিঁ-কাস্তে, কারো হাতে ছেনি। গ্রামের নাম গজাড়িগড়া হলেও এখানে আর একটিও গজাড়ি গাছ নেই। একটু বুঝনেঅলা মান্দাইরা নিজেদের মান্দাইশব্দে আপত্তি করে বলে-

মান্দিরা আমাগো মান্দাই কয় গো। কেউ কোচ, কেউ ক্ষত্রিয় বলে নিজেদের দাবি করে। দুঃখজনকভাবে গজাড়িগড়া ও তার আশপাশের মান্দাইরা নিজেদের ভাষা আর বলতে পারে না, ভুলে গেছে। তারা এখন বাংলায় কথা বলে। এখানে তারা ঘনবসতির মতো করে থাকে। কয়েক বছর পরে হয়তো মান্দাই পাড়া বস্তির মত হয়ে যাবে। কারণ তারা পরিবার পরিকল্পনা করে না, অল্প বয়সে বিয়ে করে। অবশ্য ওদের কেউ কেউ ভাগ্য বদলের আশায় খ্রিস্টান হচ্ছে। চেবেং বর্মনের নেতৃত্বে কয়েকজন এস.ডি.এ চার্চে দীক্ষা নিয়েছে আর তাপস বর্মণের নেতৃত্বে কিছু মান্দাই ব্যাপ্টিস্ট হয়েছে। এখানে অর্থনৈতিকভাবে ও শিক্ষা দীক্ষায় মান্দাইরা পিছিয়ে আছে আরেক আদি জাতি স্বত্তার উত্তরাধিকার মান্দিদের তুলনায়। মান্দাই প্রাচীণরা বলেন-আগেতো এই এলাকায় মান্দাইগো অবস্থা মান্দিগো চাইতেও ভালা আসিল। পরথম পরথম আমরাই না এলাকায় আইলাম, জঙ্গল সাফ করলাম,পরে না মান্দিরা আইল । কিন্তুক অইযে, সনাতন মান্দাইগো তো আবার বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর মান্দাইরা একটু বিলাসী, অহংকারীও আসিল। পড়াশোনাও করে নাই। ইস্কুলে ভর্তি অইলে যদি খ্রিস্টান বানায় এই ধরে ।বালিসের নিচে  তুলসী ভুল করে ৫০ টাকা রেখে গেছে। বিড়ি খুঁজতে খুঁজতে মাখন তা দেখে ফেলে। ২০-৫০ টাকা হাতে থাকলে মাখনের হাত চুলকানি শুরু হয়ে যায়। রিং মাস্টারের কলা বাগানের জুয়ার আড্ডায় মন চলে যায়। কান ধরে কতো প্রতিজ্ঞা করেছে সে -আর তাস খেলব না বলে। আজও মন মানছে না । এদিকে বুদুর চা দোকানের সামনে দিয়ে যেতেই বুদু গাল দেয়- কী রে খাঁটা ? দুই মাস অয় বাকি দেস

না।
-ধ্যাৎতেরী, এহন একহানু যাইতাসি, পরে দিমুনি।
-একহানু কই যাও জানি। তুলসীর কাসে কইয়া দিমু। খাঁটা মাখন না শুনার ভান করে গুটুর গুটুর করে হেঁটে কলা বাগানে ঢুকে পরে । কলা বাগানের সার-বিষের তীব্র গন্ধ তেমাথা বাজার পর্যন্ত চলে আসে। তেমাথা বাজারে কাঠচোর, সুদখোর, ভ্যানঅলা আর টেম্পো ড্রাইবাররা আড্ডা মারে। কেউ কেউ সারাদিন আড্ডা মারে আর বিড়ি খায়। যেন নাই কাজ, তাই খই ভাজ। কলাচাষ এলাকায় শুরু হওয়ায় দোষণ শুরু হয়েছে সবখানে। দোষণ লেগেছে বাতাসে, মনে সবখানে। কলা বেঁচে আর কলা বাগানে কাজ করে কাঁচা পয়সা আসছে হাতে। আর এই কাচাঁ পয়সার ঝন্ঝনানি আওয়াজ বাজে নিশি রাতে, এই পাড়ায়। দূর থেকে টেম্পোটে করে চুলাই মদের চালান আসে অন্ধকার হলে। প্রথমে শুকরের মাংস দিয়ে ঢুক্ঢুক্ করে গিলে খায় মদ্ । পরে নেশা হলে বলে- কই, আইস্কা কারে লাইনে রাখসস্ ।পয়সা বেশি কইরা দিমু যদি অমুকের
বউরে……………..

মোর জ্বালা, তোমার কপাল দেহি ভালা। এই বলে শম্ভু বিড়ির ফুটকিতে শেষ টান মেরে ছুড়ে দেয়। ধ্যাৎতেরী, আইস ভালা স্বপ্ন দেখসি। স্বপ্নে মেলা মাছ ধরসি। আইস্কা আমি পামুই। ইতিমধ্যেই লাভের
টাকা দিয়ে উক্কিকে বাজারে পাঠিয়ে পাইলট সিগারেট আনিয়ে নিয়েছে মাখন। তাসের আড্ডার আশেপাশে নারু, উক্কির মতো যোগানদারেরা বসে থাকে অর্ডারের অপেক্ষায়। তাদের সাথে থাকলে চা, বিড়িতো আছেই মাঝে মাঝে মদও খেতে পারে। বোমা শম্ভু আবার বলে-মোর জ্বালা, মেলা টেহা লাভ করলি, তেনাচুর (চানাচুর) চা খাওয়াবি না ?

-তুই খালি খাই খাই করস।
-হি-হি করে হাসে আর তাস বাটে বোমা শম্ভু। এদিকে লম্বা মাখনের বাড়িতে চড়গ পুঁজার মিটিং-এ বসেছে সনাতন মান্দাইরা । প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তি মেলা বসে এখানে। স্থানীয়রা একে চরগ পুঁজা বা চরগ মেলা বলে। ওদের মধ্য থেকে একজন বলল- চেবেং আর তাপসরেও মিটিং এ ডাকসি । ওরা অহন খ্রিস্টান অইলেও মান্দাই পুলা না। আব কইসে।
-হিন্দু খ্রিস্টান বইলা না। পাড়ায় অনুষ্ঠান, তাই সবারই থাহন দরকার । কইসস্ ভালা করসস্ ।মাতব্বর গোছের একজন বলল।

কতো কইসি, মাইয়্যা ডাঙ্গর অইতাসে চোখে চোখে রাখ, শাসন কর। করে নাই। পাড়ার আর বাইরের পুলাইপানরা খালি ঘোর ঘোর করে। কতো কইসি, কাঁচা বাঁশেই ঘুণে ধরে- শাসন কর। শাসন করে নাই। একলা একলা কী প্যাচাল পার, কারে গাইল দেও বুড়ী? টোট রতন জিগায়। 

-কারে কমুগো,

রাক্ষসীদা আইসকা আবার আইতাসে।
-ও, রুমার কথা কও। 
-আবার সব পুলার মাথা খারাপ করবো। স্বামী মরসে বিষ খাইয়া । এহন ঢাহা থাহে না কই কি করে কেউ জানে না। মাঝে মাঝে আহে। উই আইলেই পাড়া গরম অয়। বুড়ীর কাছ থেকে রুমার আসবার কথা শুনে রতন খুশি হয় । রাতে দালালী করে টাকা কামানোর চিন্তা মাথায় আসে। বুড়ী আবার
প্যাচাল পারে –রুমার স্বামীডা ভালা আসিল গো। কিন্তুক অই যে, দাঁড়ি ব্যাপারি মইজ্যার লগে বউডার আকাম-কুকাম যখন দেখল, পরে বিষ খাইয়া মইরা গেল গা। এসময় কোত্থেকে এক কুকুর এসে ঘরের বেড়ায় এক পা তুলে মুতে দেয়। রতন কুকুর তাড়াতে তাড়াতে তে মাথা বাজারের দিকে চলে যায়।

খাঁটা মাখনের তাস খেলায় লাভ হয়েছে। ভাতের দোকানে ঢোকে ডিম দিয়ে ভাত খায়। -ভালা অইসে, আরো দেও । দোকানি পাতে আরো ডিম ভাত দেয়। ভাত পেট ভরে খেয়ে বুদুর দোকানে যায় , বাকি শোধ করে। বুদুকে গাল দেয়-অল্প কয়েক টেহা, এই টেহাই অতগুণা মাইনসের সামনে চাইলি। নে, ধর টেহা। পান খায়পাইলট সিগারেট কিনে। সকালের কথা মনে পড়ে মাখনের । তুলসীকে বলেছিল সে-আইসকা মাছ পামু , ভালা স্বপ্ন দেখসি। মাখন মাছের দোকানে যায়, মাছ কিনে, সবজি-ডিম কিনে। অন্ধকার শুরু হয়েছে । তুলসী ঘরে পৌঁছে কুপি বাতি জ্বালায়। কুপি বাতিতে কেরোসিন কম।
বিছানার নিচে টাকা খোঁজে, পায় না। তুরসীর সন্দেহ হয়্ । সে সময় মাখন শিস্ পারতে পারতে মাছ, ডিম-সবজি নিয়ে হাজির হয়।
-খুশি অই নাই আমি । কেরা তোমারে তাস খেলাবার কইসে? এই কইরা জমি হারাইসস্ , মাইনসের বাড়ি কাম কইরা টেহা জমাইয়া ভ্যান রিক্সা কিই না দিসিলাম তাও বেইচ্যা ফেলাইসস্ , আবারও তাসের আড্ডায়ই বইলি ? মাতবরগর সামনে কান ধইরা কইসিলি আর তাস খেলাবিনা, মনে নাই ? এই বলে তুলসী কেদেঁ উঠে। মাখনের সাথে তার ভবিষ্যৎ ঘর সংসার নিয়ে ভাবে। দ্বিগীনের কথা ভাবে। দ্বিগীন তাকে এখনো ভালোবাসে। মাখনের উপর তার বিশ্বাস উঠে যায়। খুব দ্রুত এসব তুলসীর মাথায় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়। মনে মনে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে । মনের কথা গোপনে রাখতে নিজেকে সামলে
নেয়।
-ধ্যাৎতেরী, আইসকাতো হারি নাই । দেহ, মেলা টেহা। এই বলে মাখন টাকা বের করে বিছানায় রাখে ।
তুলসী ওদিকে তাকায় না ।
-কেরোসিন নাই, এহনি নিয়া আহগা মাখন টাকা পকেটে নিয়ে তেমাথা বাজারের দিকে পা বাড়ায়। তুলসী বলে-বাজারে একটুও দেরী করবার পারবানা কিন্তু। এদিকে বাজারের প্রতিটা চা স্টলে রুমাকে নিয়ে ফিসফিসিয়ে আলাপ শুরু হয়ে গেছে। মাখন শুনে ফেলে। পকেটে হাত দেয়। পকেট উঁচা লাগে। বাসনা জাগে। তাড়াতাড়ি কেরোসিন নিয়ে বাড়ি ফিরে। তুলসী বলে-তোমারে তোমার মাছ রাইন্দা দিতাসি, ভালা কইরা খাইয়্যা ঘুমায় পড়বা। 
ধ্যাৎতেরী, খাওয়ার পর পান না খাইলে অব । -চলব না, তোমারে আমি চিনি। রুমা আইলে তোমাগো তো মাথা ঠিক থাহে না।

ভাঙা ঘটিবাতির তালে পুরানো বাংলা সিনেমার গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। খাওয়া দাওয়া হয়তো শুরু হয়ে গেছে। 



দাদা, দাদা । বাইরে রতনের গলার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে । তুলসী ঘরের ভিতর থেকে উত্তর দেয়-কোন কুত্তার বাচ্চারে । 

-ইস্ , দাদার কাছে আইসকা মেলা টেহা আসিল কি না । বলতে বলতে রতন ফিরে যায়। মাখন এ সময় হে-হে-হ করে হাসে। তুলসী বলে-বোকায় বিলে হাসে অন্যের হাসি দেইখ্যা, তুই হাসস কিসের নিগা।-তোমার নিগা । তোমার মত বউ যার ঘরে সে কোন দু:খে পর নারীর কাসে যাব। তোমার যা গাল। কথায় কয় না-ডাইলের মজা ঝালো, নারীর মজা গালো। তলসী কুটি বস্তা থেকে অসম্পূর্ণ কাঁথা বেড় করে কাঁথা সেলাইয়ে মন দেয়। কাঁথা সেলাই করতে করতে বলে-
তোমারে আমি চিনি। মেলা টেহা নষ্ট করসস পর নারী আর জুয়ার পেছনে। অগ্যতা মাখন পাইলট সিগারেট জ্বালায়, আয়েশে ধোঁয়া ছাড়ে, আর ফাঁকে ফাঁকে গান গায়-ছি;ছি;ছি;ছি লইজ্জায় মরি একি তোমার ব্যবহার।

এদিকে নকুলের শিষ্য দ্বিগীন দ্রিম-কুড়-কুড়-কুড়-কুড়-কুড়-কুড়, দ্রিম কুড়-কুড়-কুড়-কুড়-কুড়- কুড় তালে ঢাকে বুল তোলে। সুতা টানে, ঢাকের সুর ঠিক করে । নকুলের পর ঢাকের দায়িত্বটা এসে পড়েছে দ্বিগীনের উপর। দুই বছর আগে নকুল মারা গেছে যক্ষায় । আর স্বামী মারা যাবার পর তুলসী হাঙ্গা বিয়া করে খাঁটা মাখনকে । দ্বিগীনের তুলসীর প্রতি টান ছিল প্রচণ্ড। কিন্তু চালু মাখন কেমন করে যেন পটিয়ে হাঙ্গা বিয়ে করে ফেলে তুলসীকে । এরপর পাড়ায় রটনা ছড়িয়ে পড়েছিল এভাবে-মাখন অ-ষুধ কইরা তুলসীরে বিয়া করসে। নইলে তুলসী কী মাখনরে………
দ্বিগীনও নকুলের মতো পা নাচিয়ে নাচিয়ে ঢাক বাজায় । নকুলের ঢাকের সুরে পাগল হয়ে তুলসী নকুলকে বিয়ে করেছিল। তুলসী কী তারই শিষ্য ঢাকি দ্বিগীনের দ্রিম কুড়-কুড়-কুড়-কুড়-কুড় বুল শুনছে। এক সময় পকেটের মটর বিড়ি পড়ে যায় উঠোনে। চওড়া হাসি হেসে হেমন্ত পাগলা তা তুলে দিতে আসে। দ্বিগীন ঢাক বাজানো রেখে বলে-

নাগবোনারে, আমিই তুইলা নিতাসি একটু জল খাইয়া বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া সাইরা নিমু আগে। আইসকা এম্নি বাজাইয়া দেখতাসি তো।

-হ, একটু পরে একহানু যামুনি। হেমন্ত বলে।

-রাহ তোমার রুমা। খালি রুমা রুমা কইরা তোরা মরস। 
-এ্যাঁ, তুইওতো তুলসীরে না দ্যাখলে থাকা হাস না ।
-ধ্যাৎ-ধ্যাৎ, তুলসীর লগে রুমার তুলনা । সব দিক দিয়া তুলসীই সুন্দরী । এ সময় হেমন্ত ঢাকের কাটি নিয়ে বাজানোর চেষ্টা করে। দ্বিগীন বলে,
-গান গাইলেই গান অয় না। হেমন্ত জবাব দেয়,
-আমার বাজানিও একদিন বাজনা অব। দ্যাইখো, হেইদিন তুলসী খাড়াইয়া খাড়াইয়া আমার বাজানিও দ্যাখব্ । দ্বিগীন হেমন্তের কথায় মুচকি হেসে বিড়িতে তীব্র টান টেনে এক্কেবারে অর্ধেক করে ফেলে।
বিড়ির ফুটকি হেমন্তের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,-খাবা ?-না, দিলে আমানদিই দে ।

খালি ছি;ছি;ছি;ছি; লইজ্জায় মরি- ভূবনে এই গানডিই পারো । তার উপর তোমার যে গলা ,আর গাইয়ো না তো। মাইনসে জড়া অব। কিয়ের নিগা কান্না কাটি করতাসস্ তাই মনে কইরা। এই বলে শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠে তুলসী। মাখন তাকিয়ে থাকে মুগ্ধ হয়ে। এ সময় তুলসীর বুকের কাপর পড়ে যায়। 

-কি এমন কইরা চাইয়্যা দেহ ড্যাব ড্যাব কইরা। বলতে বলতে সুই-সুতা নিরাপদ জায়গায়

সরায় তুলসী। আবার বলে,
-মাচা থিকা নাইম্যা আইতে পারো ন্। মাখন কুপি বাতি নিভিয়ে দিয়ে বাঁশ-পাটির বিছানায় শোয় তলসীকে বুকে জড়িয়ে ধরে।রাত ভেঙে দুমরে মুচরে মান্দাই পাড়া যখন কেঁপে ওঠে দ্বিগীনের দ্রিম কুড়-কুড়-………তালে ঢাকের কাব্যিক সুরের ব্যাঞ্জনায়, তখন তুলসী মাখন তাদের আদি প্রবৃত্তি নিবারনে নিমগ্ন, আরেক নিশি রাইতের পদ্য রচনায়। এ সময় তুলসীর মনশ্চক্ষে ভাসছে ধবধবে সাদা ধূতী পরা নকুলের প্রতিচ্ছবি । ফর্সা ধূতি পড়ে পা কুঁদে কুঁদে নেচে নকুল চড়গ পূঁজার হাজিরার রাতে ঢাক বাজাত। শঙ্খর করুণ ধ্বণী, আর নকুলের ঢাকের সুর শুনলে তুলসী ঘরে থাকতে পারতো না। আজও থাকতে ইচ্ছে করছে না । তার ইচ্ছে করছে এ মুহুর্তে মাখনকে উপর থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে দ্বিগীনের কাছে ছুটে যেতে। সত্যি সত্যি জোরে ধাক্কা মারে তুলসী। ছিটকে পড়া মাখনের মাথা পেরেক বিঁধানো বাঁশের বেড়ার খামে লাগে। অজ্ঞান হয়ে যায় মাখন। এদিকে দরজা খুলে অন্ধকার ভেঙে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে তুলসী যেদিক থেকে ঢাকের শব্দ আসছে সেদিকে——-যেন কৃষ্ণের
বাঁশির ডাকে রাধা ছুটে যায়-অন্ধকারের সব ঝঞ্জাল সামনে থেকে সরিয়ে সরিয়ে………….



No comments:

Post a Comment