বিকু
হেরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে জীবন সাজানোর স্বপ্ন দেখা এক আদিবাসী তরুণের গল্প
-বচন নকরেক
এটা ঢাকা শহর তো, হিসাব কইরা চলতে হয় । ডন্ট মাইন্ড ভাইস্তা-বলে ফিডেল মারাক পাশ ফিরে বসে বয়াম থেকে চিড়া-গুর বের করে খাওয়া শুরু করল । ফিডেল মারাক সিকিউরিটি সুপারভাইজার। তার অধীনে ৩০ জন সিকিউরিটি গার্ড বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস ও বাসাবাড়িতে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করে। তাদের মধ্যে বিকুও একজন। বিকু ফিডেল মারাকের সম্পর্কে ভাইস্তা হয়। সারাদিন গ্রামের চা-স্টলে বিড়ি খেয়ে, আড্ডা মেরে কাটিয়ে দিত সে। রানু স্বামীর এহেন কুড়েমী স্বভাব দেখে সহ্য করতে না পেরে ঢাকা চলে আসে কাজের খোঁজে। প্রথমে গৃহপরিচারিকা হিসেবে এক ফিরিঙ্গির বাসায় কাজ জোটলেও এ বাসার ছেলের লালসা থেকে বাচাঁর জন্য কাজ ছেড়ে চলে যায় এক বান্ধবীর বাসায়। বান্ধবী বিউটি র্পালারে কাজ করে । তার বান্ধবী রানুকে দেখে খুশী হয়। বলে-তোমাকে আগেই বলেছিলাম ঢাকা চলে আয় বলে। তোর যে চেহারা সব মালিকই তোমাকে পছন্দ করবে। আমার সাথে থেকে আগে কাজ শিখে নে, দেখবি তোমার অ-নে-ক চাহিদা। মাত্র ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া কাজলীর মুখে অমন ঝরঝরে বাংলা শুনে রানু মুগ্ধ হয়। হবেই বা না কেন, প্রায়তো পাঁচ বছর হয় কাজলী ঢাকা এসেছে। সারাদিন বাংলা বলে কাস্টমারদের সাথে।
বিকুর মাথা ঘুরছে। খিদেয় পানির বোতল খুঁজে পাচ্ছে না । পানি খেতে পারলে একটু বল পাওয়া যেত। মেসের ভাত হতে রাত ৯টা বেজে যাবে। ডে ডিউটি করে ক্লান্ত খুব । ক্লান্ত দেহটা বিছানায় ছেড়ে দিয়ে অনেক কথা মনে পড়ছে বিকুর। নরসুন্দর (নাপিত)কিরনের সাথে পালিয়ে যাবার দুদিন আগে রানু ফোন করে বলেছিলো-ঢাকা আর ভালোলাগে না, বাড়ি ফিরে যাবো। একথা শুনে বিকু বলেছিলো-আরে, আমিও তো ঢাকা যাচ্ছি নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ নিয়ে, থাকতে থাকো। এক সময় আমাদেরও উপার্জন বাড়লে আমরাও অন্যদের মতো বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবো। অন্যরা পারলে আমরাও পারবো। এদিকে টান জমি যা ছিল তাও লিখে দিতে হয়েছে আগস্টিন মাস্টারকে আসলসহ সুদের টাকা পরিশোধ করতে যেয়ে। আনারস চারা লাগানোর জন্য ১০ হাজার টাকা নিয়েছিল বিকু তার কাছ থেকে। তিন বছরে শোধ করতে পারেনি তাই তা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে হয়ে যায় ৮০ হাজার টাকা। মাস্টার আগস্টিনের হিসেব মতে তা বেড়েছে এভাবে, ১০ হাজার টাকার এক বছরে সুদে-আসলে হয়েছে ২০ হজার টাকা। এভাবে ২০-৪০, ৪০-৮০ হাজার টাকা। চত্রবৃদ্ধি শোধ বলে কথা। আসলে শোষক আগস্টিনের আগে থেকেই লোলুভ দৃষ্টি ছিল বিকুর ৬০ শতক উচুঁ জমির দিকে। সরল বিকুর সেদিকে খেয়াল ছিলো না। সে মনে করেছিলো নিজের মানুষের কাছ থেকে নিয়েছি যখন এক সময় আসলসহ কিছু লাভ দিয়ে দেব। কিন্তু আগস্টিন এ নিয়ে একদিন মানুষ ডাকলো। সেদিন সবাই মাস্টারের পক্ষে কথা বলেছিল। কারন চালাক মাস্টার তার পক্ষে কথা বলানোর জন্য প্রচুর ‘চু'র ব্যাবস্থা করেছিল। এবং একই পদ্ধতিতে গ্রামের মোড়লদেরও পক্ষে নিয়ে তার অনেক অন্যায় ধামাচাপা দিয়ে রাখত। একমাত্র আরেক স্কুল শিক্ষিকা বিরনি তার হয়ে আগস্টিন মাস্টারকে কয়েক কথা শুনিয়েছিল। বিরনি দিদি বলেছিলো-তোরা না মিশনের খ্যাটেকিস্ট শিক্ষক, তোমরাই যদি এরকম শোষক হও তাহলে এ মানুষগুলো কার কাছে ভরসা করবে ? বিরনিদির কথার উত্তরে আগস্টিন বলেছিল- আমাগ তো চলতে অয়। মিশনের স্কুলে বেতন আর কত পাই। তাই সাইড ব্যবসা আমাগ করা লাগে। শেষে বিরনিদি‘র কথায় ও গ্রামের আরো ভালো মানুষের কথায় আগস্টিন মাস্টার ৮০ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা ছাড় দিয়েছিলো। এবং বাকি ৫০ হাজার টাকা বাবদ তার মোট ৬০ শতক জমির ৪০ শতক উপস্থিত সবার সামনে সুদখোর মাস্টারকে লিখে দিয়েছিল। বাকি ২০ শতক রইল বাড়ি ভিটা। সেদিন থেকে বিকুর মনে হয়েছে আসলে শোষকরাই আলাদা জাত। চামার-চারাল, মান্দি-মান্দাই, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, আদিবাসী-অ-আদিবাসী এভাবে তাদের আলাদা করা যায় না। সব সমাজ, সব জাতির ভিতরই তাদের অস্তিত্ব। সবখানে তাদের লোলুভ থাবার বিস্তার । তাদের মনুষত্ববোধ কম। ফুলের গন্ধ তাদের আপ্লুত করে না। কেবল সারাদিন মাটি-টাকা-নারী, নারী-মাটি-টাকা বলে কৌশলে না পারলে কেড়ে হলেও অন্যের অন্ন নিজের করে নেয়ার জন্য তারা মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় ও্তঁ পেতে বসে থাকে । আগস্টিন মাস্টারের এখন অনেক জমাজমি হয়েছে। বিকুর মত মাক্কু, মাহাঙ্গুদের ঠকিয়ে সিঃস্ব করে দিয়ে। সম্পদশালী হয়ে ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করছে ঠিকই। কিন্তু কিছুদিন আগে বড়ো মেয়েটা ভিন জাতির এক ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে। বিকু বিছানায় উঠে বসে পড়ে আর মনেমনে বলে-একেই বলে অন্যের গায়ে থুথু দিলে নিজের গায়েই লাগে। জমি হারানো স্ত্রী হারানো অর্থাৎ তার এরকম দুর্বিসহ জীবনের জন্য বিকু পরোক্ষভাবে আগস্টিন মাস্টারকেই দায়ী করে। মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্য ৫০ হাজার টাকা বাবদ ৪০ শতক জমি লিখে দিতে হয়েছিলো ভালোমানুষের ভান করে থাকা শোষক আগস্টিন মাস্টারকে। আর তার পরিবারের এরকম সংবাদ শুনে বিকু খুশী হয় মনে মনে।আড্ডাবাজ, আইলসা বিড়িখোর এরকম অপবাদ থেকে নিজেকে আস্তে আস্তে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে বিকু। একদম আর বিড়ি খায় না। মন দিয়ে ডিউটি করে। ক্রেডিটে হিসেব খুলেছে। এক বছরে প্রায় ১০ হাজার টাকার মতো জমা হয়েছে। হয়তো জীবনের কঠিন বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তার এ বদলে যাওয়া। সামান্য অর্থের জন্য প্রথমে জমি শেষে স্ত্রী রানুকে হারিয়ে তাই আর্থিক ব্যপারে সে এখন এতো সচেতন।
তারমতো অন্য আরেক মহাজনের খপ্পরে পড়ে পর্যুদস্ত হওয়া উজ্জ্বল সাংমার কথা খুব করে মনে পড়ছে তার। হাসিও পায় সে কথা মনে পড়লে। মাত্র ৫০০ টাকার জন্য ৫০০০ হাজার টাকা তাকে নগদ পরিশোধ করতে হয়েছিল। উজ্জ্বল সাংমা মহাজনকে টাকা পরিশোধের নির্দিষ্ট তারিখ দেয়, তারিখ মতো মহাজন আসে তো উজ্জ্বল বাড়িতে থাকে না। এভাবে অনেক বছর কেটে গেল। কিš ‘ নাছোড়বান্দা মহাজন একদিন হাতেনাতে ধরে ফেলল। উজ্জ্বল বলল-আরে ভাই, ঠিক সময়েইতো এসে পড়েছেন। আর আমারো টাকা জোগার হয়ে গেছে। বসুন। এদিকে আমার পেটে বেরাম। এইতো আবারো পায়খানার চাপ শুরু হয়ে গেলো।একটু বসুন আপনারা । পায়খানা থেকে ফিরেই টাকা দিয়ে দিচ্ছি-বলে প্লাস্টিকের ঘটিতে জল নিয়ে চলে গেলো কলাপাতার বেড়া আর চট দিয়ে দরোজা বানানো পায়খানায়। মহাজন, উজ্জ্বল পালাচ্ছে নাতো -এই সন্দেহে তার সঙ্গের লোককে লক্ষ্য রাখার জন্য পাঠিয়ে দিলো। মহাজনের সঙ্গের লোকটা ঠিকই দেখল উজ্জ্বল চটের দরোজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেছে, বের হলেতো দরজা দিয়েই বের হবে -ভেবে দরজায় তীক্ষ্ণ নজর রেখে বসে রইল। এদিকে উজ্জ্বল পেছন দিয়ে কলাপাতার বেড়া গলে বেড়িয়ে আনারসের ক্ষেত হয়ে পালিয়ে চলে গেলো দূরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। এভাবে মাসখানেক সে নিখোঁজ হয়ে রইলো। আর এদিকে এত সময় নিয়ে কেউ পায়খানা করে!-বলে মহাজন নিজে ঢুকে দেখে উজ্জ্বল পায়খানায় নেই। পেছনের কলাপাতার বেড়া ভাঙা। এভাবে নানা চেষ্টা কসরত করেও অবশ্য উজ্জ্বল মহাজনের হাত থেকে রক্ষা পায় নি। মাত্র ৫০০ টাকার জন্য ৫০০০ টাকা তাকে দিতেই হয়েছিল। একবার ইরি ক্ষেতে চোর, লুচ্ছা, সুদখোর মহাজন এরকম যত্তো খারাপ লোকের নাম লিখে ত্রিভুজ আকারের নিশান বানিয়ে গেড়ে রেখেছিলো। এ ব্যপারে তাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে উজ্জ্বল বলতো-সমাজের এসব পোকাগো লগে ধানের পোকারাও থাকতে শরম পায়, শেষে ক্ষেত থিকা পালাইয়া যায় গা ।
রানুকে কতো ভালোবাসতো বিকু। সেই ছোট্ট বেলা থেকে। পুতুল পুতুল দেখতে স্কুল ফাংসনে রানু পারফরম করতো-‘আলতো পায়ে ছন্দ তোলে সাজের বেলায় গাঙের কোলে, ঝলকে বধু যায়....’ এই গানের তালে। সেই সোনাঝরা দিন মনে পড়লে মনে দোলা লাগে, বুকটা ছ্যাঁত করে উঠে। অই যে ফোনে রানু বলেছিলো -ঢাকা আর ভালোলাগে না, বাড়ি ফিরে যাবো। কেন সে এ কথা বলেছিল ? কিরন নামের নাপিতটা নিশ্চয় সে সময় ডিস্টার্ব করছিল। এমনো তো হতে পারে নাপিত কিরন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে রানুকে। যাহোক রানু এ্খন অন্যের স্ত্রী। বিকু তাকে ভুলেই থাকতে চায় কিন্তু এক টুকুন ফাঁক পেলেই রানুর অতীত ঢুকে পড়ে ঘরের ভিতর। কখনো বিকু নিজেও ইচ্ছে করেই খুলে রাখে অতীতের জানালা। নইলে দমবন্ধ কষ্টে অস্থির হয়ে পড়ে নিজেই, খোলা জানালা দিয়ে সতেজ অতীত প্রবেশ না করলে।
আজ ডিউটি করে মেসে ফিরতেই ফিডেল মারাক হাসিমুখ করে বলে-পোষাক পাল্টাইয়া আমার লগে লও চা খামুনি। অইতো, ফিডেল মারাকই মাঝেমাঝে তাকে চা খাওয়ায়। পকেটে টাকা থাকলেও বিকু চা খায় না। ফিডেল বাবুর মনে হয় আজকে ফাও ইনকাম হয়েছে। গ্রুপের একজন একটু ভালো কাজ পেয়ে অনত্র চলে গেছে। সম্ভবত, অই পোস্টে নতুন লোক এসেছে। নতুন লোক এসে জয়েন করলে তাকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। বিকুকেও দিতে হয়েছিল। ‘-অই, চায়ের আগে এ্কটা কইরা সিঙ্গারা দেও।’ ফিডেল মারাক অর্ডার করে। শোন, তোমার জন্য একটা মেয়ে দেখতাসি। অতীত একটু ভালানা। মানে বিদেশী হাউজে কাজ করতো তো অ-ই শালাগো বীর্যের একটা বাচ্চা আছে আর কি। এমনিতে মেয়েটা সবদিক দিয়া ভালা। তবে এইটা র্দুঘটনা মনে কইরা গ্রহণ করলে সুখী অইবা। ব্যাংকে অ নে ক টাকা জমা আছে। দ্যাখ , চিন্তা কইরা। অরাও আসলে ভালা একটা পাত্র খোঁজাতাছে কি না। আমারে যখন কইলো, তখন তোমার কথাই মনে অইলো। বিকু বললো-- ডোন্ট মাইন্ড আঙ্কেল, আমি আপাতত বিয়া নিয়া ভাবতাছিনা, ড্রাইভিং শিখার লিগা টাকা জমাইতাছি। আগে ড্রাইভিং শিখমু তারপর না হয়....
চাঁদ দেখার জন্য ছাদে উঠে মনটা তার ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে বিকুর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ রুপোর থালার মতো ছোপ ছোপ কালো কালো দাগাঙ্খিত চাঁদের শরীরে। তাই বুঝি কবিরা বলেন...‘চাঁদেরও কলঙ্ক হয়।’ ঝাপসাভাবে তার মনে পড়ছে কোন এক লেখকের কথা-‘যতই ময়লা পড়ুক, গঙ্গার জল পবিত্রই।’ বিকুর কাছে রানুও গঙ্গার জলের মতই পবিত্র যেন। সময় ও পরিস্থিতির ফাঁদের আঠায় আটকা পড়া পাখি সে । খাঁচামুক্ত হয়ে একদিন কি আবার বিকুর কাছেই ফিরে আসবে রানু ? তাহলে..... ‘সে যে-ন মোর চির চেনা, মনের রাজকণ্যে,গানের মালা নিশিদিন পা'য়-জাগি তার জন্য।’অনেকদিন পর সিগারেটের ধোঁয়া বিকুর মুখ থেকে বেড়ুচ্ছে। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার ভিতর বিকু দেখে হাত বাড়ানো রানুর অসহায় মুখ...বিকু এগিয়ে যায়...এগুতে থাকে তীব্র ধোঁয়া ছেড়ে ছেড়ে-----