পাতা পোড়া বন



পাতা পোড়া বন
-বচন নকরেক

পাতা ঝরার দিন। পাতা শুন্য ডালগলো। খাঁ-খাঁ-হা-হা বন। টিনের চালা ঘরের বারান্দায় বসে বিড়িতে তীব্র টান মেরে রাগ ঝাড়ে আর প্যাচাল পারে পলাশ।
-‘অনেক কষ্টে আনারস লাগাইসি। শুঁড় নাড়াইয়া নাড়াইয়া আনারস বড় অইতাসে। এমন সময় পিকনিকে আইয়্যা শহরের মানুষগুলা জ্বলনের নিগা বারুদ অইয়্যা থাকা শুকনা পাতায় বিড়ির আগুন ফালাইয়্যা দেয়। শালারা বন পুইড়া থুইয়া যায়, সে আগুন আইয়া লাগে বাগানে। সেই আগুন নিভাইতে গিয়া আমারও হাত পুইড়া গ্যাসেগা।উঠানের গামারী গাছটা বড় বাড়া বেড়ে গেছে। শীতাকালে চালে রোদ পড়ে না। ৫০ ওয়াটের সৌর প্যানেলে ঝরঝরে রোদ না পড়লে বেশিক্ষণ আলো দেয় না তাই গামারীসহ ঘরের দক্ষিণের কয়েকটি গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। তাছাড়া ভিটেবাড়ির বাগানে দুয়েক ফজলী আম গাছ আছে। গাছের ছায়ায় ফসল ভালো হয় না। বড় বড় গাছগুলো বেছে বেছে বিক্রি করে দিলে হাতে কিছু নগদ টাকাও আসবে , বাগানও ভালো হবে  

ঋণি
৪র্থ শ্রেণিতে পড়ে। খরের চালের বারান্দায় বসে মা মেয়ের মাথার উকুন দেখে দিচ্ছে। এমন সময় ফাদারের হোন্ডা সামনের রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে।-অই যে ফাদার ঋিণিদের বাড়িতে এসেছিল, চলে যাচ্ছে। আচ্ছা মা, ফাদারেরা আমাদের বাড়িতে আসেনা কেন ? ঋণির মা সেমতি বলে,-‘তাও জান না? গরিব বলে। আমরা দুমুঠো দুবেলা ভাতই খেতে পারি না। কেউ এলে আপ্যায়ন করবো কী দিয়ে ?’ -‘তাই বলে তারা গরিবের বাড়িতে আসবে না?’ ঋণি বলে। -‘আসুক বা না আসুক তাতে তোমার কী ? ভাত বেড়ে দিচ্ছি তাই খেতে আয়।মা ধমকের সুরে বলে। বন পুড়ে যাবার পর বছর প্রচুর বৃষ্টি হযেছে। বন আলু, বন শাক নতুন পাতা ছেড়ে জেগে উঠছে। সময় বিশেষ করে চৈত্র বৈশাক মাসে বনজাত দ্রব্য সংগ্রহের জন্য বনবাসী মানুষেরা দলে দলে বনের ভিতর ঢোকে। ঋণির মা প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে ঋতুর মার জন্য। ভাতের থালা হাতে নিয়ে মার কাছে এসে ঋণি বলল,-‘মা, আজকে কিন্তু আমিও যাবো।মা সেমতি বললো,-‘না, তুই যাবি না। তোর না পরীক্ষা আছে। তাছাড়া প্রচুর চীনা জোঁক আছে বনে।সে সময় ঋণির সহপাঠী ঋতু এসে বললো, -‘মা না কি আজ যাবে না। তার শ্বাস কষ্ট। তাছাড়া দুদিন আগে না কি পিকনিকে আসা লোকগুলো বনের ভিতর একা পেয়ে শিশিলিয়া মাসীকে অপমান না কি যেন করেছে। তাই মা ভয়ও পাচ্ছে।’ -‘- আচ্ছা, তোর মা না গেলে আমিও যাবো না সেমতি বলল।
জয়ার চা স্টলে ভ্যানঅলা গুটু বন রুটি চুবিয়ে ভিজিয়ে মজা রে চা খাচ্ছে। ব্রিটিশ পিরিয়ড দেখা গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীণআন্দ্রেস পাবেঞ্চের এককোণে বসে বড়িবিড় করে প্যাচাল পারছে এই বলে,-‘আগে কী গভীর বন আসিল। হঠাৎ দুএকজন বাঙ্গাল এলাকায় এসে পড়লে সবাই এসে জড়ো হতো বাঙ্গালদের চেহারা কেমন, তাই দেখতে। এমনও আছে জীবনেও বাঙ্গাল দেখে যায় নি। গভীর বনের ভিতর নিজেদের মতো করে তারা জীবন যাপন করে গেছে। ইচ্ছে মতো বনে ঘুরে বেড়ালেও বন্য জন্তু ছাড়া কোন কিছুর জন্য ভয় পাবার কারণ ছিল না। আর এখন চারিদিকে বাঙ্গাল আর বাঙ্গাল। কী দ্যাখলাম কী অইল। এহন বনে গেলে বনপ্রহরী আর পিকনিকের লোকদের জন্যও ভয় করতে হয়। নিজেগো বনে ইচ্ছামত আর কিছুই করন যায় না। মেয়ে ছেলেরা লাখড়ি নিতে যেতে পারে না।বিপন্ন বন নিয়ে লিখতে আসা ফ্রিলেন্স সাংবাদিক শামীম বুড়োর পাশ ঘেঁষে বসে বুড়োকে চা সিগারেট সাধে। আন্দ্রেসপা বলে,-‘ না, আমি নিজের বিড়ি খাই, অন্যের দেয়া কিছু খাই না।দোকানি জয়াও বললো,-‘দাদু, কারো সাধা কিছু খায় না।বন পাহাড়ে বসবাসকারী বনবাসী, আদিবাসী মানুষগুলো নিজেদের ইচ্ছেবন ইচ্ছেপাহাড়ে ইচ্ছেমত চষে বেড়াবার, স্বাধীন জীবিকার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। উচ্ছেদ ভয়ে তথস্থ্য থাকে তারা সর্বক্ষণ। কলম থুয়ে নিয়ে ঢক্ ঢক্ করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিল শামীম। রুহীর সাথে কথা বলতে হবে। রুহী কবিতা লিখে। তার কবিতায় বন-পাহাড়-সমতলের আদিবাসীদের অধিকারের কথা উঠে আসে। দলিত সমাজের মানুষের অস্তিত্বকে সরকার সাংবিধানিক ভাবে স্বীকার করে নেয় নি এখনো। কবি রুহীর সাথে বসলে অনেক তথ্য পাওয়া যেতে পরে। আর বুড়োটার সাথেও ঘণিষ্ট হয়ে নেয়া দরকার। অনুমানের উপর কোন প্রতিবেদন লিখবে না শামীম। আরো নারী নেতৃত্বের সাথেও কথা বলে নেয়া প্রয়োজন। রুহী বারান্দায় বসে ডায়রিতে কী যেন লিখছে। কবিতা হবে হয়তো। বেঞ্চে বসা রুহী, সামনে টি টেবিল, ঠোঁটে সিগারেট, আরো সামনে লাল হয়ে ফোটা রাঁধাচুড়াসহ চুপি চুপি রুহীর একটা জীবন ছবি টেক হয়ে গেল শামীমের ডিজিটাল ক্যামেরায়। -‘রুহীদা, ভাল আছেন।বলে শামীম বারান্দায় উঠে এলো। -‘, সাংবাদিক সাহেব, এতোদিন পর এলেন।পূর্ব পরিচিত দুজনের মধ্যে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা-অনুসন্ধান-বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যা শুরু হয়ে যাবে কিছুক্ষণ পরে।
পলাশের কাছে খবর এসেছে আজ -কো পার্ক বিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশ হবে জালাবাদা। মাথাফুলা মিঠুন থাকবে এর নেতৃত্বে। ছেপা শুঁটকীর ভর্তা দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে পলাশ প্রস্তুত হয় প্রতিবাদ সভায় যোগ দেয়ার জন্য। পুরানো রয়েল সাইকেল ঘর থেকে বের করে নারকেল তেল মাখে। পকেট থেকে পাইলট সিগারেট বের করে জ্বালাতে জ্বালাতে তার স্ত্রীকে বলে,-‘ আঞ্জুমা, মিছিলে যাইতাসি। কাঠের মহাজন আইলে বা আমি বাড়ি নাই, পরের দিন যেন আহে।কথা শেষ করে প্যাডেলে পা রাখে পলাশ। আদা বুনার জন্য খেত প্রস্তুত করতে থাকা অনিল পলাশকে জিগায়,‘কই যাও আঞ্জুবাপ ?’ পলাশ ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে বলে,-‘লও যাই জালাবাঁধা আইস্কা কাম বাদ দেও।

একটা
জংলী মিছিল জলছত্র থেকে জালাবাদার দিকে এগিয়ে আসছে মাথাফুলা মিঠুনের নেতৃত্বে।ইকো-পার্ক বন্ধ কর, ইকো-পার্ক চাই নাশ্লোগানে জয়েনশাহীর আদিবাসী নারী পুরুষের অংশগ্রহণে। মাটি কুঁদেকুঁদে বজ্র শ্লোগানে তরুণের দল এগিয়ে যাচ্ছে শুরু করে দেয়া দেয়ালের দিকে মিছিলটা কাছে এলে পর দেয়ালের আড়ারে ওঁত পেতে থাকা দালাল আদিবাসীদের মদদে বন প্রহরী আর প্রশাসনের লোকগুলো গুলি ছোড়া শুরু করে। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সময় কেউ কেউ দালালদের দেখে ফেলে। গুলির ভয়ে না পালিয়ে এগিয়ে যেতে থাকা সাহসী যারা তারা দালালদের লক্ষ্য করে গালিগালাজ করে। মাটিয়ে লুটিয়ে পীরেন, উৎপল, পলাশ কাৎরাতে থাকে। আতাকা গুলির শব্দে হতভম্ব হয়ে দৌড় শুরু করা কিছু তরুণ সাহস সঞ্চয় করে ফিরে এসে লাঠি, দা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে যেদিক থেকে গুলির শব্দ আসছিল সেদিকে। এসময় মটর সাইকেলে করে দালালরা পালিয়ে যায় আঁকাবাঁকা সরু জঙ্গল পথ ধরে। -‘অই কুত্তার বাচ্চারা, অহন পলাস কে’-বলে মাথাফুলা মিঠুন দা উচিঁয়ে তাড়া করে। এদিকে পীরেন, উৎপল পলাশের অবস্থা আশংকাজনক। তাদের অবস্থা দেখে কেউ কান্নাকাটি করছে, কেউ হাসপাতালে নেয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছে। এসময় শামীম রুহী এসে উপস্থিত হয়। রুহী তিনজনের পালস্ পরীক্ষা করে। শামীম ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়। সে সময় কোত্থেকে যেন এক সাদা কবুতর উড়ে যায় ঊর্ধ্বাকাশের দিকে, রুহী দেখতে পায়। হতাশ মুখ করে রুহী উঠে দাঁড়ায় সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তার মুখে এসে পড়ে। রুহী বলে উঠে,-‘এদের তিনজনের একজন আর নেই। আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা কর।
#
(বি:দ্র:- এই গল্পের সাথে বাস্তব ঘটনার কোন মিল নেই। সময়, গল্পের কাহিনী চরিত্রগুলো লেখকের কল্পনা অনুসারে বিণ্যাস করা হয়েছে

No comments:

Post a Comment