শিক্ষার বাতিঘর প্রতিভা সাংমা, হা'বিমা এলাকার মান্দিদের মাঝে ছড়িয়েছেন শিক্ষার বিকিরণ!

হা'বিমানি রা'সং

প্রতিভা সাংমা, শিক্ষার বাতিঘর

তাঁর অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী, হা’বিমাজুড়ে। প্রতিভা সাংমা অভিভাবক, এলাকাবাসী, এবং তাঁর ছাত্র-ছাত্রীর হৃদয়ে বেঁচে আছেন মূর্তিমান এক জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে।
আর এই কারণেই আজো কারো কাছে তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক, কারো কাছে একজন আদর্শ মানুষ। সবকিছু ছাড়িয়ে যেটা সবচেয়ে বড় পরিচয় তাঁর তা হলো, তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারিগর। যিনি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে হাজারো কীর্তিমান তৈরী করে অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে আলোকিত করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে গেছেন অবসরের আগ পর্যন্ত। অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে গড়ে তুলতে যে অপরিসীম জীবনী শক্তি লাগে; তা তো কেবল একজন শিক্ষকেরই থাকে । প্রতিভা সাংমারও ছিলো।


প্রতিভা সাংমার জন্ম ১৯৩২ খ্রিঃ ডিসেম্বরে। বাবা মৃত সনাতন মৃ, মা মৃত বংগবালা চাম্বুগং। চার ভাইবোনের মধ্যে প্রতিভা সাংমা ছিলেন তৃতীয়।



১৯৩৮ সালে তিনি ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলো মধুপুর । একেতো ঘন বনে ঢাকা ছিলো গ্রাম। সন্ধ্যা হলে বাঘের গর্জন, শেয়ালের ডাক শোনা যেত। বন্যশুকর উঠোনে চলে আসত খাবারের খোঁজে। বনমোরগ, ময়ূর , টিয়া-শালিক কত রকমের পশুপাখিতে ভরা ছিলো। মা বংগবালা চাইলেন তাঁকে পড়ালেখা করানোর। যা ভাবা তাই কাজ। সুদূর ময়মনসিংহে গ্রাম থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এলেন। সেখানে শিশু হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছেন প্রতিভা সাংমা। ১৯৪৯ সালে এ স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পাস করেন। আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন । উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা থাকলেও পারেন নি। ময়মনসিংহের স্কুলে পড়ার সময় ছুটি পেলে বাড়ি আসতেন। বাড়ি এসে দেখতেন, নিজ সম্প্রদায়ের মানুষেরা অশিক্ষা কু-সংস্কারে ডুবে আছে। তখন তাঁর মনে প্রশ্ন জাগত, এঁদের কি শিক্ষিত করা যায় না ? তখন থেকেই শিক্ষকতার মহান পেশাকে জীবনের ব্রত হিসেবে নেওয়ার ইচ্ছা জেগেছিলো তাঁর।



১৯৫২ সালে ময়মনসিংহ শহরের হলিফ্যামিলি হাইস্কুলে শিক্ষিকা হিসাবে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন । হালুয়াঘাট উপজেলার সেন্টমেরি মিশনারি হাইস্কুলেও শিক্ষকতা করেছেন । ১৯৭০ সালে তিনি হালুয়াঘাটের সেন্টমেরি মিশনারি হাইস্কুলের চাকরি ছেড়ে নিজ গ্রামের স্কুলে চলে আসেন। ভুটিয়া প্রাইমারি স্কুলে তিনি নামমাত্র বেতনে শিক্ষকতা করে গেছেন। পীরগাছা স্কুলেও তিনি কাজ করেছেন। এছাড়াও আশপাশের দুটি মিশন স্কুলে অতিথি শিক্ষক হিসাবে বিনা বেতনে ক্লাস নিতেন। ১৯৭২ সালে মধুপুর গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা হলে তিনি সেখানে যোগ দেন। এবং এখান থেকেই ৯১ সালে অবসর গ্রহণ করেন।



তিনি ছিলেন সংস্কৃতিমনা। তখন মান্দিরা মিশনারিদের প্রচারে প্রভাবে সুপ্রাচীন ধর্ম সাংসারেক ছেড়ে খ্রিস্টান হচ্ছিল। তিনি তখন বলতেন , খ্রিস্টান হলেও মান্দিরা মান্দিই থাকবে। নিজের কৃষ্টি-সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। সংস্কৃতি চচার্র প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সরকার আদিবাসী কোটায় গালর্স গাইডের নেত্রী হিসেবে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাকিস্তানের পেশোয়ারে পাঠিয়েছিলেন।



একদা অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকা হা’বিমার মান্দিদের মাঝে শিক্ষার মশাল হাতে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে তিনি শিক্ষা দান করেছেন। টাকা পয়সার কথা তাঁর মাথায় আসেনি। তিনি চাইতেন শিক্ষায়দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা সমাজে শিক্ষার প্রদীপ জ্বালাতে। মান্দি সমাজে শিক্ষার আলো ছড়ানোয় তাঁর অসামান্য অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ।



একাত্তরে তিনি পাকিস্তানি হানাদারদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জলছত্র মিশনে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে চিকিৎসা দিতেন।

ডেইলি স্টার ও আইপিডিসি ফিন্যান্স লিমিটেডের উদ্যোগে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য প্রতিভা সাংমাকে “Unsung Women Nation Builders 2018”   বিশেষ সন্মাননা দেওয়া হয় ।



প্রতিভা সাংমার বয়স প্রায় নব্বইয়ের কাছাকাছি হবে। এ বয়সেও চশমা ছাড়াই পত্রিকা, বই পড়েন। ২০০১ সালে তাঁর ঘর পুড়ে এবং স্বর্ণালঙ্কারসহ অনেক দামি জিনিস পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সাথে সাথে তাঁর কষ্টে গড়া পারিবারিক পাঠাগারটিও পুড়ে যায়।



পরের জন্য নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করে গেছেন তিনি। অন্যের বিয়ে-থার খরচ দিয়েছেন । কিন্তু নিজেরই সংসার করা হয় নি। চিরকুমারী রয়ে গেলেন শিক্ষার বাতিঘর খ্যাত প্রতিভা সাংমা।