হা’বিমার মান্দি রাজা খ্যাত পরেশ চন্দ্র মৃ-র সংক্ষিপ্ত জীবনী!
"We are the children of the forest. We were born here. We were brought up here. We want to die here. We are so accustomed to the forest life that we cannot survive if evicted from the forest."
.
" আমরা বনের সন্তান। বনে আমাদের জন্ম। বনেই বেড়ে উঠেছি। বনেই মরতে চাই। এই বন জীবনে আমরা এতোটাই অভ্যস্ত যে , এখান থেকে উচ্ছেদ করলে বাঁচতে পারবো না।"
.
- পরেশ চন্দ্র মৃ
.
হা’বিমার মান্দি রাজা খ্যাত পরেশ চন্দ্র মৃ-র সংক্ষিপ্ত জীবনী!
.
মিঃ গজেন্দ্র মৃ
অনুলিখনঃ বচন নকরেক
(মানুষ তার কাজের মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকে। ভালো কাজের জন্যে মানুষ তাকে মনে রাখে। সমাজে কিছু মানুষ থাকে যারা জাতিকে সমাজকে এগিয়ে নেবার জন্য সারা জীবনই নিজেদের ব্যপৃত রাখেন। নিজ সমাজ-পরিবার থেকে সব রকম অজ্ঞতা, কু-সংস্কার, অন্ধকার, অন্যায্যতা প্রভৃতি দূর করে আলোকিত সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেন। জাতির দুর্দিনে-দুঃসময়ে-সংকটে-বিপদে পথ দেখান সামনে থেকে মশাল হাতে। মরে গেলেও তার কাজ, তার আদর্শ, চিন্তা, দর্শন ও ত্যাগ অনেকদিন বেঁচে থাকে মানুষের ভিতর। তেমনি একজন পরেশ চন্দ্র মৃ যে মধুপুর গড়ের জয়েনশাহী আদিবাসীদের বন বিভাগ ও সরকার কর্তৃক উচ্ছেদ প্রচেষ্টার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নিরীহ, নিরক্ষর (সেই সময়ে) জয়েনশাহী নিবাসী আদিবাসীদের বনে, বন পরিবেশে টিকে থাকার, বেঁচে থাকার লড়াইয়ের সংগ্রামে নেতৃত্বে দিয়েছেন অনেক বিপদের মুখোমুখি হয়ে , নানা প্রলোভন ও স্বার্থ চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে রেখে । নেতৃত্ব দেবার সব গুণাবালী ছিলো পরেশ মৃ’র (দৃঢ় মনোবল, সঠিক সিদ্ধান্ত , উপস্থিত বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, সাহস ও সততা ) মধ্যে। তাঁরই বড়ো ভাই গজেন মৃ’র কলমে শুনে নিই পরেশ মৃ’র বেড়ে উঠা, পড়াশুনা, জীবন সংগ্রামের কথা। প্রয়াত গজেন্দ্র মৃ’র ডায়রিতে লেখাগুলো প্রায় অক্ষত রেখেই আমি চেষ্টা করেছি কম্প্যুটারে কম্পোজ করার। মাঝে মাঝে কিছু ভাষাগত পরিবর্তন ছাড়া। )
১৯৩০ সনে চুনিয়াতে পরেশ মৃ’র জন্ম হয়। বাল্যজীবন, শিশুকাল চুনিয়াতে কাটে। এখানেই তার ধীরে ধীরে বড় হওয়া। বনেই জন্ম, বনেই বেড়ে ওঠা। এখানেই মৃত্যু বরণ করেন তিনি।
নিজ গ্রামে স্কুল না থাকায় ১৯৩৬ সনে ভূটিয়া ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি প্রাথমিক স্কুলে পড়াশুনা আরম্ভ করেন। তখন সাইনামারী গ্রামে কাথলিক প্রাইমারি স্কুল ছিলো। দেবেন দফো (প্রবীন চিসিমের বাবা) সেখানে মাস্টারি ও ক্যাটিখিস্টের কাজ করতেন। পরে সেখান থেকে পীরগাছা গ্রামে স্কুল আনা হয়। দেবেন দফোর সাথে কাজ করতেন মাধব পাল নামের একজন হিন্দু শিক্ষক।ময়মনসিংহ মিশনের বড়ো ফাদার ছিলেন ফাঃ কেইন। তাঁর দ্বারা বোর্ড স্কুল করা হয়। অর্থাৎ তখনকার সরকারের কাছে দেওয়া হয় ও সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়। ভূটিয়া থেকে এসে পরেশ মৃ পীরগাছা স্কুলে ভর্তি ও পড়াশুনা করেন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। পীরগাছা স্কুল থেকে চতুর্থ শ্রেণি পাশ করে মধুপুর হাই স্কুলে ভর্তি ও পড়াশুনা করেন। সেখানে সে বঙ্কিম চক্রবর্তী নামের এক হিন্দু পরিবারে জায়গির থাকতেন নিজ খরচে। বাড়ি থেকে তাঁর জন্য মাসে মাসে চাউল, টাকা ও লাখড়ীও দেওয়া হত। বঙ্কিম চক্রবর্তীর পরিবারের লোকেরা রান্না-বান্না করে দিত। মধুপুর হাই স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়াশুনা করার সময় বঙ্কিম চক্রবর্তী ভারতের কলকাতায় পালিয়ে যান। তখন ১৯৪৫-৪৬ সালে নোয়াখালী, কলকাতা পাঞ্জাবে হিন্দু মুসলিম ভীষণ দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়। শত শত হিন্দু মুসলিম সে দাঙ্গায় মারা যায়। ভয়ে বঙ্কিম চক্রবর্তী পালিয়ে যায় ভারতে। নারিকেল ডাঙার সে ফোন করে পরেশ মৃকে সঙ্গে নিয়ে যায়। নারিকেল ডাঙার জর্জ হাই স্কুলে পরেশ মৃ ১০ম শ্রেণিতে ভর্তি হন ও পড়াশোনা করে্ন। বঙ্কিম চক্রবর্তী তার বাড়িতে থাকাবস্থায় পরেশ মৃকে হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ-মহাভারত, গীতা ও বেদান্ত শাস্ত্র পড়তে দিত, সে নিজেও এসব বিষয়ে পরেশকে শিক্ষা দিত। এভাবে পরেশ মৃ একসময় হিন্দু মনোভাবাপন্ন হয়ে যান। সাথে সাথে বঙ্কিম চক্রবতী সাম্যবাদ, নাস্তিকবাদ , ম্যাক্সিমগোর্কি, এঙ্গেল ও লেলিনের মতবাদ, নীতি ও জীবনাদর্শন পড়তে দিতেন। এভাবে পরেশ মৃ এক সময় নাস্তিকবাদী হয়ে ওঠেন। বঙ্কিম চক্রবর্তীর পরিবারে পরেশ মৃ’র স্বাস্থ্য ভালো থাকতো না। প্রায়ই অসুখ ও জ্বর হতো। পরে সে গ্রামে চলে আসেন। ইদিলপুর গ্রামে মিজি মৃ নামের এক প্রাচীন জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান মহিলা ছিলেন। তিনি ‘চার্চ অব বাংলাদেশ’ এর ধর্মালম্বী ছিলেন। মিজি মৃ মণ্ডলী নেতৃত্ব দিতেন ও পরিচালনা করতেন। তার বাড়িতে ছিলো গীর্জা ঘর। সুস্থ্য হওয়ার পর পরেশ মৃ মিজি মৃ’র বাড়িতে যাতায়াত করতেন। সম্পর্কে পরেশ মৃ মিজি মৃর আত্মীয় ছিলেন। পরিবারের ছেলের মতই মিজি মৃ’র পরিবারের সবাই পরেশ কে আদর যত্ন করত। মিজি মৃ ও তার পরিবার পরেশ মৃ’কে পরামর্শ দিয়ে বললেন, পরেশ, তুমি আবার কলকাতায় চলে যাও সেখানে আমাদের মিশনারির ভালো স্কুল আছে, সেখানে ভর্তি হও মেট্রিক পাষ করে আস। পরেশও যাবার স্বীকার করল কিন্তু হঠাৎ করে তাঁর গলা ও মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে লাগলো। গ্রামের লোকেরা বলাবলি করা আরম্ভ করলো- ‘জাওয়ানি জাক’ অর্থাৎ কেউ তাকে ঔষধ খাইয়েছে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে । কবিরাজ চিকিৎসা ছাড়া ভালো হবে না। তাদের কথা মত হাতুরে কবিরাজ আনা হল কিন্তু নিরাময় হল না। ।
দিনকে দিন অসুখ বেড়ে চলল। শেষে ধরাতি গ্রামের লক্ষণ মৃ পরামর্শ দিলো তাকে ময়মনসিংহের সেন্ট মাইকেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নইলে পরেশ বাঁচবে না। তাকে সেখানেই নিয়ে যাওয়া হলো। পরীক্ষায় ধরা পড়ল তার যক্ষা হয়েছে। তখন সেখানে ডাঃ হিসেবে কর্মরত ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা চিকিৎসক মিঃ বেনেডিক্ট ইবাং। তার হাতে পরেশ মৃর চিকিৎসা হয় এবং পরেশ ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে উঠেন। পরেশ ম্রর যে রুমে থাকতেন সে রুমে থাকতেন আরেক টি.বি রোগে আক্রান্ত বাঙালি খ্রিস্টান মিঃ চার্লস পিউরিফিকেশন। চার্লস পরেশ মৃকে জিজ্ঞাস করলেন, সে খ্রিস্টান কি না। পরেশ উত্তর দিলেন - না, আমি সাম্যবাদী ও নাস্তিকবাদী। অন্য রুমে ছিলেন আরেক টি.বি রোগী ভির্জিনা গমেজ। তিনিও শুনতে পেলেন যে, টি.বি রোগে আক্রান্ত হয়ে এক শিক্ষিত গারো ছেলে চিকিৎসার জন্য এসেছে। সে অখ্রিস্টান, সাম্যবাদী-নাস্তিকবাদী ও হিন্দু মনোভাবাপন্ন। ভির্জিনা গমেজ পরেশ মৃ’র মন পরিবর্তন ও খ্রিস্টের প্রতি যেন বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এর জন্য নিয়মিত প্রার্থনা করতে লাগলেন। যেহেতু দু’জনই ছিলেন রোগী সেহেতু উভয়ের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হতো না। ভির্জিনা গমেজ প্রথমে চিঠির মাধ্যমে পরেশ মৃ’র পরিচয় নিলেন এবং সবসময় তার খোঁজ খবর নিতে লাগলেন। পরেশের মন পরিবর্তনের জন্য বাইবেল ও অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ্ পাঠাতে লাগলেন। পরেশও সে সব যত্ন ও মন দিয়ে পড়াশুনা করতে লাগলেন।মিঃ চার্লস পিউরিফিকেশনও পরেশ মৃকে কাথলিক মণ্ডলীর শিক্ষণীয় বিষয়, যাবতীয় বই যেমনঃ-বাইবেল, কাথলিক ধর্মতত্ব, খ্রিস্টের অনুকরণ বই, কৃপা শাস্ত্র, সাধু-সাধ্বীদের বই ইত্যাদি পড়তে দিতেন। এবং তা পরেশকে পড়িয়ে বুঝাতেন ও শিক্ষা দিতেন। পরেশ মৃ নিজেও ফাঁকে ফাঁকে বাইবেল পড়তেন ও বুঝতে চেষ্টা করতেন। এভাবে আস্তে আস্তে পরেশ মৃ কাথলিক ধর্মে আকৃষ্ট ও বিশ্বাসী হয়ে উঠেন। পরেশের মন পরিবর্তনের জন্য ভির্জিনা গমেজের অনেক অবদান আছে। ভির্জিনা গমেজ শেষ পর্যন্ত টি.বি রোগে মারা গিয়েছিলেন। চালর্স পিউরিফিকেশন ভালো হয়ে চাকরী করেন এবং বিয়ে করে সুন্দর সুখী জীবন যাপন শুরু করেন। পরেশ মৃও রোগ মুক্ত হয়ে বাড়ি চলে আসেন। এবং সবার সাথে বসবাস শুরু করেন।
.অবশেষে ১৯৫২ সালের ১৭ মার্চ খ্রিস্টান কাথলিক ধর্মে আকৃষ্ট হয়ে বাপ্তিষ্ম গ্রহণ করেণ।সুস্থ্য সবল হলে পর আবার ইদিলপুরে মিজি মৃর বাড়িতে যাওয়া শুরু করেন। একদিন মিজি মৃ পরেশকে বললেন, আমার আনারস বাগান আছে। চারা নিয়ে লাগাও। তোমার যথেষ্ট আয় হবে, চাকরি না করলেও চলবে। আনারস চারা এনে বাগান করা হলো এবং চারা গাছের ফল হওয়া শুরু করলো। সে ফল বিক্রি করে সংসারে আয় বৃদ্ধি পেল। সাথে সাথে বিভিন্ন ফলের গাছ যেমন-লিচু, লেবু, আম, কাঁঠাল, জাম্বুরা, কলা এবং শাক-সবজি প্রভৃতি লাগাতে লাগলেন। এবং গ্রামের সবাইকে ফলজ গাছ ও শাক-সবজি লাগাতে পরামর্শ ও উৎসাহ দিতে লাগলেন। তার কথা মতো ও পরামর্শ মতো গ্রামের অনেকেই আনারস ও অন্যান্য ফলজ গাছের বাগান করা শুরু করলো। তাতে পারিবারিক আয় বৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ হলো। পরেশ মৃ সব সময় মানুষকে সৎ পরামর্শ দিতেন। তিনি জানতেন যে, একা বাঁচা যায় না। তিনি সব সময় সবার উন্নতি ও সমৃদ্ধির চিন্তা করে গেছেন।
এক সময় চুনিয়া ও পীরগাছা গ্রামের মান্দিরা ঘোর সাংসারেক ছিলো। তারা বিভিন্ন দেবদেবীর পুঁজা করত। নিয়মিত রংচুগালা, ওয়ান্গালা পালন করতো। সুসুমী, সালজং, তাতারা প্রভৃতি বিভিন্ন দেবদেবীকে সৃষ্টিকর্তাতুল্য সন্মান ও ভালোবাসত ও পুঁজা দিত। আমাশা, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়া, মাথা ব্যথা, বুক ব্যথা, পেট ব্যথা প্রভৃতি জটিল রোগের নিরাময়ের জন্য তারা শুকর, ছাগল (পাঁঠা), মোরগ-মুরগী জবাই করে দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করত (নকনি মিদ্দি, চুরাবুদি, চিছামি, রাগ্গাসি, গয়েরা, দেনছাম পক, জংকিপ্রা, বিদাওয়ারি নামের বিভিন্ন দেবদেবীর )। একসময় পরেশ মৃ গরিব মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেবার জন্য এলোপ্যাথিক চিকিৎসার বই এনে পরাশুনা করেন এবং চিকিৎসার অভ্যাস করেন। এভাবে বহু রোগী তার কাছে চিকিৎসা নিয়ে বাঁচে। আবার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার বই এনেও পড়াশুনা করে প্র্যাকটিস আরম্ভ করেন। তার কাছে কম খরচে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিয়ে অনেক গরিব রোগী রক্ষা পায়। সে সময় পরেশ ডাক্তার হিসেবে আদিবাসী বাঙালি সবার কাছে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য বাবু পরেশ চন্দ্র মৃ- হিসেবেই তিনি সর্বাধিক
পরিচিতি পান। সাথে সাথে পরেশ মৃ ধর্ম প্রচারও করতেন এবং গ্রামবাসীর মন পরিবর্তনের জন্য প্রার্থনা করতেন। প্রত্যেক পরিবার যেন নিজ নিজ ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়, লেখাপড়া শেখায় এর জন্য পরেশ মৃ গ্রামবাসীকে উৎসাহ যোগাতেন, উপদেশ ও পরামর্শ দিতেন।
শিক্ষার আলো নতুন জীবন ও পথ দেখায়। অজ্ঞতা, অন্ধতা ও কু-সংস্কারাচ্ছন্নতা হতে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড, উন্নয়নের মূল উৎস, কেন্দ্র ও ভিত্তি। পরেশ মৃ তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি এলাকার মানুষকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য ১৯৭২ সালে পীরগাছায় ‘পীরগাছা সাধু পৌলের উচ্চ বিদ্যালয় ’ নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এলাকাবাসীর সহযোগিতায়। বর্তমানে যেখানে কম্পিউটার ঘরটি সেখানে প্রথমে বেড়ার ও পরে মাটির ঘর তৈরী হয়েছিলো। প্রাথমিক অবস্থায় ঘর তৈরীর কাজ খুব কঠিন ছিলো। তবে পরেশ মৃ-র নেতৃত্বে ধীরে ধীরে স্কুল ভবন তৈরীর কাজ এগিয়ে যায়। প্রথমে স্কুল ঘরের জন্য জমি নির্বাচন করা হয়। এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি চাওয়া, জমির মূল্য নির্ধারণ করা, জলছত্র মিশনের ফাদারের সাথে যোগাযোগ করা এসব পরেশ মৃ করতেন। শ্যামচরণ রেমা নাম মাত্র মূল্যে প্রায় ৫ একর জমি স্কুলের জন্য দেন। তিনি গ্রামের লোকদের নিয়ে ফরেস্টার, রেঞ্জারের সাথে দেখা করে স্কুল ঘরের জন্য কাঠ চান। অনুমতি পাবার পর বন থেকে কাঠ কেটে এনে চিরাই করা, রুয়া-সারক কাটা, ধন্না কাটা, ঘরের জন্য জানলা দরোজা, বেঞ্চ বানানো, কামলা, স্বেচ্ছাশ্রম যোগার ইত্যাদি যাবতীয় কাজ নিজে তদারকী করতেন। দীর্ঘদিন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির চ্যায়ারম্যান পদে থেকে সুষ্ঠুভাবে স্কুল পরিচালনায় সহায়তা করে গেছেন তিনি।তিনি ছিলেন ‘পীরগাছা সাধু পৌলের উচ্চ বিদ্যালয় ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ‘পীরগাছা সাধু পৌলের উচ্চ বিদ্যালয় ’-এর পূর্ব পার্শ্বের একটি ভবনকে তাঁর নামে নামাকরণ করে রাখা হয়েছে ‘পরেশ চন্দ্র মৃ হল রুম’ হিসেবে। ফাদার হোমরিক যখন জলছত্র মিশনে আসেন তখন নতুন করে পীরগাছা গ্রামে গীর্জা ঘর ও প্রাইমারি স্কুল নির্মিত হয়। পরেশ মৃর নেতৃত্বে গ্রামের লোকেরা গীর্জা ঘর ও প্রাইমারি স্কুল ঘর নির্মাণের কাজে সহায়তার জন্য আসত। ফাদার হোমরিক জলছত্র মিশনে আসার আগে পীরগাছা প্রাইমারি স্কুল ছিলো সরকারী বোর্ড স্কুল। এখানে বাঙালি শিক্ষক মিঃ এডুইন রোজারিও শিক্ষকতা করতেন। একবার লম্বা ছুটিতে তিনি বাড়ি যান। স্কুল খোলার তারিখ মতো তিনি আসেন নাই। দেরী করে আসেন। একদিন দেরীতে স্কুল খোলার সময় স্কুল পরিদর্শক হঠাৎ করে এসে উপস্থিত হন। তিনি দেখতে পেলেন ছাত্র নেই, স্কুল ঘর নোংরা আবর্জনায় ভরা। তিনি বোর্ড স্কুল কেটে ভেঙে দেন। তখন ফাদার স্টিফেন ডায়াস জলছত্র মিশনে ছিলেন। তিনি মনে করলেন বোর্ড স্কুল ভেঙে গেলেও মিশন প্রাইভেট প্রাইমারি স্কুল হিসেবে রাখতে হবে। ছেলেমেয়েরা যেন শিক্ষার আলো পায়। সাথে সাথে ধর্ম প্রচারও যেন চলতে থাকে। এ কাজে ফাদার চুনিয়ার পরেশ মৃ-কে আহবান করেন। ফাদারের আহবানে পরেশ মৃ সাড়া দেন ও কাজ করতে শুরু করেন। তখন স্কুল ছিলো পীরগাছায়, আর গীর্জা ঘর ছিলো চুনিয়াতে দেবেন দফো’র বাড়িতে।
পীরগাছা ও চুনিয়ার লোকেরা মিলেমিশে গীর্জা ঘরে প্রার্থনা ও আরাধনা করতো। ফাদার স্টিফেন ডায়াস ও ফাদার হোমরিক মাঝে মাঝে মিশা দিতে আসতেন। আর্চ বিশপ গ্রেনারও হস্তার্পণ দিতে আসতেন। গ্রেনার স্বদেশে চলে গেলে বিশপ অমল গাঙ্গুলিও হস্তার্পণের জন্য চুনিয়ায় আসতেন। ময়মনসিংহ ডায়োসিসের বিশপ ফ্রান্সিসের (প্রয়াত) বড় ভাই জন গমেজকে ধর্ম প্রচারের কাজে পীরগাছায় পাঠানো হয়। মিঃ পরেশ মৃ, মিঃ জীবন নকরেক, মিঃ দেবেন দফো প্রমুখ ব্যাক্তিগণ জন গমেজকে ধর্ম প্রচারের কাজে সহায়তা করতেন। তাদের অক্লান্ত চেষ্টা, পরিশ্রমের ফলে বহু সাংসারেক মান্দি খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলো। একবার একদিনেই ৬০ জন লোক খ্রিস্ট ধর্মে বাপ্তিষ্ম গ্রহণ করেছিলো। ধীরে ধীরে উত্তর চুনিয়া ও দক্ষিণ চুনিয়াতে বহু নরনারী খ্রিস্টা ধর্মে দীক্ষিত হয়। পীরগাছায় খ্রিস্ট বিশ্বাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে চুনিয়ার গীর্জা ঘর পীরগাছায় আনা হয়। গীর্জা ঘরের জন্য মাটির দেওয়াল তোলার সময় পরেশ মৃ কামলা যোগার করে , গ্রামবাসীকে স্বেচ্ছাশ্রম দেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। ঘরের জন্য বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করার জন্য বন বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে অর্থাৎ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে।
১৯৫২ সালে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হলে গারোদের প্রধান জাতীয় পেশা জুম চাষ বন্ধ হয়ে যায়। এতে গারোরা অসুবিধায় ভোগে। তখন গরিব ও বনবাসী মান্দিরা বনে জুম চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করত। জীবিকার উপর এরকম নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা সামলে ওঠা গারোদের জন্য খুবই কঠিন হয়ে পড়েছিলো। ১৯৫৬ সালে বন বিভাগ চুনিয়াতে লট করা আরম্ভ করে। প্রতিটি লটে ১০ একর জমি থাকত। বন বিভাগের মানুষ লটের গাছ সমূহ নিলামে বিক্রি করে দিত। বড় বড় মহাজনেরা লটের গাছ কিনে নিত। লটের গাছ বিক্রি করার পর লট পরিস্কার হলে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার পর গারোরা জমি ভাগ করে নিয়ে সেখানে ধান, পাট, সরষে ও অন্যান্য ফসল চাষ করত। বন বিভাগ মান্দিদের আবাদী জমিতে গজারি গাছের বীজ রোপন করত। মান্দিদের আবাদী জমি বাদ দিয়ে যাতে লট করা হয় এরজন্য পরেশ মৃ বন বিভাগের বড় বড় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে কথা বলতেন । তারা তাঁর কথা শুনেন, বিবেচনা করেন। এবং মানবতার খাতিরে আবাদী জমিগুলো বাদ দেয়।
১৯৫৫ সালে পাকিস্তান শাসন আমলে বন বিভাগ ও তার কর্তৃপক্ষ সারা পূর্ব পাকিস্তানের আওতাভূক্ত ১৯১৩ সাল থেকে ১৯১৯ সালের সি.এস.সি রেকর্ড বাদে সমস্ত পত্তনি জমি নোটিফিকেশনের মাধ্যমে খাস ঘোষণা করে এবং গাছ লাগানো শুরু করে বন বাড়ানোর জন্য। সে সময় পত্তনি জমি বন বিভাগের কাছ থেকে রক্ষার জন্য পরেশ মৃ এলাকার লোকদের নিয়ে লড়াই করে । অবশেষে পত্তনি জমি বাদ দিয়ে বন বিভাগ বন সৃজন করে। পরেশ মৃ-র অক্লান্ত পরিশ্রম সার্থক হয়।
ভালুকা থানাধীন নলুয়াকুরী গ্রামের বঙ্ক চিসিম ও কুমুদিনী দারুর মেয়ে শিশিলিয়া দারুর সাথে ১৯৫৬ সালে বিয়ে হয় পরেশ মৃ’র। পরেশের বাবার নাম ছিলো রায়চান নকরেক। রায়চান নকরেকের ২ জন পত্নী ছিলো -টেংয়া মৃ ও ছেংয়া মৃ। টেংয়া মৃ বহুদিন যাবৎ নিঃসন্তান ছিলেন। বংশ রক্ষা ও বংশের প্রদ্বীপ জ্বালাবার জন্য সন্তান লাভের আশায় রায়চান নকরেক ২য় বিবাহ করেন ছেংয়া মৃকে। কিন্তু শেষে প্রথম স্ত্রী টেংয়া মৃ-র কোলেই ২ জন সন্তানের জন্ম হয়। গজেন মৃ ও পরেশ মৃ টেংয়া মৃ’র কোলেই জন্ম হয়। শেষ পর্যন্ত রায়চান নকরেকের ২য় স্ত্রী ছেংয়া মৃ নিঃসন্তানই থেকে যান।রায়চান নকরেক গজেন মৃ ও পরেশ মৃ দুই ভাইকে প্রায়মারি ও মাধ্যমিক স্কুল পর্যন্ত পড়ান। এবং দুই ভাইয়ের জন্যেই বাড়িতে বউ এনে দেন। সে সময় রায়চানকে অনেকেই পরামর্শ দিত, তুমি দুই ভাহকে জামাই পাঠিয়ে দাও। বরং সাদু, আদার কাছ (ভাইরা) থেকে নক্না (পোষ্য মেয়ে) এনে জামাই আন। তারা তোমার লালন পালন করবে, যত্ন আত্তি করবে ও দেখাশোনা করবে। ছেলের বউয়েরা তোমার দেখশোনা করবে না, সেবা করবে না । কিন্তু রায়চান তাদের কথা , পরামর্শ ও যুক্তি শুনেন নাই। দুই ছেলের জন্য বাড়িতে বউ এনে যৌথ পরিবারের মতো থাকতেন। রায়চান তার সম্পত্তি তিন ভাগে ভাগ করেছিলো এভাবে-১. পরেশ মৃ ২. গজেন মৃ এবং ৩. রায়চান, টেংয়া ও ছেংয়া-র জন্য। গ্রামে সে সময়কার গ্রু-খামাল (আইনবিদ) সারিনাথ নকরেক ছিলেন রায়চান নকরেকের বড় ভাইরা। সারিনাথ নকরেক রায়চান নকরেককে পরামর্শ দিলেন- শেষের ভাগের সম্পদ মৃ মাহারির সম্পদ হিসেবে রাখতে হবে। গজেনের স্ত্রী রুগা, এবং পরেশের স্ত্রী দারু তারা এর ভাগ পাবে না। গজেন অথবা পরেশ যদি সামাজিক অন্যায় করে (গ্রুনাংয়ে রনও, রুগা দারু গ্রি না গ্রু গাম না নাংন। রুগা , দারু গ্রু চাগিপা)। সে সময় মৃ ও দারু, রুগা চাচ্চিরাসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিগণ উপস্থিত ছিলেন। সবাই তার কথা মেনে নেয়। পরে রায়চান নকরেক গজেন মৃ ও পরেশ মৃ’কে বলেন-তোমরা তোমাদের ছেলেদের জন্য মৃ মাহারির বউ নিয়ে আসবে তাহলেই হবে। গজেন মৃ ও পরেশ মৃ বাবা রায়চান নকরেকের কথা মেনে নিয়েছিলেন। গজেন মৃ তার ছেলের জন্য মৃ মাহারি বউ এনেছেন। পরেশ মৃও ছেলের জন্য মৃ মাহারি বউ এনেছেন। পরেশ মৃ তার বাবা, মা ও সৎ মাকে দেখা শোনা করে গেছেন, চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন।
১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের আমলে দোখলা ন্যাশনাল পার্ক করা হয়। ৪০ বর্গ মাইল জমি তারের বেড়া দিয়ে এর অন্তর্ভূক্ত করা হয়। চুনিয়া, পীরগাছা, ভূটিয়া, সাইনামারী, থানারবাইদ, হাগুড়াকুড়ী, জয়নাগাছা, বেদুরিয়া, সাধুপাড়া, গাইরা, টেলকি, জলই, কাকড়াগুণী প্রভৃতি মান্দি অধ্যুষিত গ্রাম এর আওতায় পড়ে। সাথে সাথে বন বিভাগের কর্মচারীরা মান্দিসহ অন্যান্য আদিবাসীদের উচ্ছেদের কথা মৌখিকভাবে জানিয়েও দেয়।
১৯৬২ সালের ৫ ই এপ্রিল ‘জলছত্র জয়েনশাহী আদিবাসী ঋণ দান সমবায সমিতি লিঃ’- গঠন করা হয় ক্রেডিট আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ফাদার জে ইয়াং কর্তৃক। তখন ফাদার ইয়াং পরেশ মৃকে হিসাব রক্ষণের কাজ করানোর জন্য হিসাব নিকাশ ও বুক কিপিংয়ের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। পরেশ চন্দ্র মৃ বহু বছর জলছত্র ক্রেডিটের পরিচালনা ও সেবা দান করে গেছেন। পরেশ চন্দ্র মৃ ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ’এরও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ১৯৬২ সালের ২ ই মার্চ এলাকাবাসীকে নিয়ে তিনি ঐতিহাসিক এই সংগঠনের জন্ম দেন। অদ্যাবদি আবিমার তথা মধুপুর, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়ার আদিবাসীরা এই সংগঠনের নেতৃত্বেই বিভিন্ন সামাজিক ও জাতীয় ইস্যুতে প্রতিবাদ করে, সমস্যাসমূহের সমাধানের উপায় বার করে। তিনি বিচক্ষণতার সাথে ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ’ সংগঠনের দ্বারা বহু সামাজিক ও জাতীয় বিপদসমূহ মোকাবেলা করেন, বনে টিকে থাকার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন।
১৯৬২ সনে পাকিস্তান সরকার শুধু চুনিয়া গ্রামবাসীকে সরিয়ে অন্য জায়গায় পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করে। তখন যাবতীয় তথ্য বিশেষ করে কার কত খাস ও পত্তনি জমি আছে, কত একর বাগান আছে, কয়টা আম, কাঁঠাল গাছ আছে, আনারস বাগানে কত হাজার আনারসের চারা আছে, অন্যান্য ফলের গাছ কয়টা আছে, টিনের ঘর কয়টা, ছনের ঘর কয়টা, হাঁস-মুরগী কয়টা, শুকর কয়টা, পরিবারের সদস্য সংখ্যা কয়জন ইত্যাদি তথ্য সার্ভে করা শুরু করে। পাকিস্তান সরকার দেখলো ও চিন্তা করলো যে, চুনিয়ার মানুষগুলো বড়ই শক্ত ও যুক্তিবাজ। নানান যুক্তি টাল বাহানা দেখায়। চুনিয়ার মানুষকে সরাতে পারলেই অন্যান্য গ্রামের মানুষকেও সহজেই উচ্ছেদ করা যাবে। চুনিয়া গ্রামবাসী তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কিন্ত একজন পরেশ মৃ দৃঢ়তার সাথে তাদের পাশে ছিলেন, ভয়ে সাহস দিতেন, সান্ত¦না দিতেন। বলতেন-তোমরা ভয় করো না, ঈশ্বর আমাদের এই সমস্যা থেকে রক্ষা করবেন ও বাঁচাবেন। ১৯৬৪ সালে কলমাকান্দা, নালিতা বাড়ি, হালুয়াঘাট, দূর্গাপুর ও শ্রীবর্দী থানার গারো, হাজং, ডালু, বানাই, হদি ও অন্যান্য যত আদিবাসী ছিলো তারা সবাই সীমান্তবর্তী রক্ষী বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ণ এবং গ্রামে চুরি, ডাকাতি, লুটপাত, খুন, নারী নির্যাতন ইত্যাদি দেখে অতিষ্ঠ হয়ে, ভয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে (আসাম) পালিয়ে যায়। এ ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারকে অবহিত করা হলে সরকার কোন প্রকার ব্যবস্থা নিত না। দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার চিন্তা করত না।
দেশের অরাজক পরিস্থিতিতে বর্ডার এলাকার আদিবাসীদের পালানো দেখে আবিমার (জয়েনশাহী) আদিবাসীরাও চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিলো, আমরা থাকতে পারব না, আমাদেরও পালাতে হবে। থাকলে সকলকেই মরতে হবে। কিন্তু পরেশ মৃ সকলকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন যে, আমাদের পালাতে হবে না। আমাদের কিছু হবে না। আমরা যে যেখানে যেভাবে আছি সেভাবেই থাকব। আমাদের শান্তি, নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা আসবেই। ঈশ্বর আমাদের সকল বিপদ, সংকট থেকে রক্ষা করবেন। ভারতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যারা পালিয়ে গেছে তারাও আলোচনা , সমালোচনা করতে লাগলেন- পরেশ মৃ আসলেই আবিমার মান্দিরাও আসত, বাঁচত। তারা সবাই মুসলমানদের অত্যাচার, উৎপাত ও নিপীড়নে মারা যাবে। কিন্তু পরেশ মৃ জানতেন যে একবার এলাকা ছেড়ে চলে গেলে পরে ফিরে এসে জায়গা জমি, ঘরবাড়ি, ভিটে, গরু-ছাগল কিছুই পাওয়া যাবে না। সব বেদখল হয়ে যাবে।
১৯৬৪ সালের দিকে পরেশ মৃ আবার টিবি রোগে আক্রান্ত হন। তিন মাস বারমারী হসপিটালে চিকিৎসার জন্য ছিলেন। সে সময়েই তাঁর মা টেংয়া মৃ মারা যায়। মার মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন পরেশ মৃ। পরে তাকে ঢাকার হলিফ্যামিলি হসপিটালে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। ময়মনসিংহের সেন্ট মাইকেল হসপিটালে রেখে তার চিকিৎসা চলতে থাকে। মাঝে মাঝে ঢাকায় পাঠানো হতো পরীক্ষার জন্য। এখানে তিন মাসের মতো চিকিৎসার পর সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেন পরেশ মৃ।
১৯৬৭ সনে দোখলার জাতীয় পার্কে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান আসেন। পার্ক এলাকার সমস্ত আদিবাসীদের সরিয়ে দিয়ে বাইরে পুনর্বাসনের ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু পরেশ মৃ সবাইকে নিয়ে পার্কের ভিতর বসবাস করতে থাকেন। এবং ১৯৬৮ সালে যথারীতি উচ্ছেদের নোটিশ পাঠানোও হয় চুনিয়া গ্রামবাসীর জন্য। নোটিশে উচ্ছেদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ন্যায্য ও উচিত মূল্য দেয়া হবে বলে বলা হয়। গ্রামের সরল লোকদের অনেকেই ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তখন। কিন্তু পরেশ চিন্তা করলেন, টাকা নিলেই বিপদ ঘনিয়ে আসবে। তৎক্ষণাৎ পরেশ মৃ মাস্টার দেবেন দফোকে সাথে নিয়ে ময়মনসিংহে চলে যান এ বিষয়ে কথা বলার জন্য। ম্যাজিস্ট্র্যাট, ডিপো ও অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট লিখিত দরখাস্ত দেন এভাবে যে, জাতীয় পার্ক হোক আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা যে যেখানে, যেভাবে আছি সেখানে, নিজ নিজ জায়গায়, নিজ জমাজমিতে, ঘর বাড়িতে যেন থাকতে পারি। সেখান থেকে যেন আমাদের উচ্ছেদ করা না হয়। বনে জন্মেছি, বনেই বেড়ে উঠেছি। এই বন জীবনে আমরা এতোটাই অভ্যস্ত যে, এখান থেকে উচ্ছেদ করলে আমরা বাঁচতে পারব না। আবেদনের পর সাময়িক উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধ ছিলো।
১৯৬৯-১৯৭০ সনে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিহারীরা পরেশ মৃ’কে দেখার জন্য তাঁর বাড়ি যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু পথ দেখানোর জন্য যাদের আনা হয়েছিলো তারা বিহারীদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলো যে, পরেশ মৃ’র বাড়ি গভীর বনের ভিতর। অনেক দূরে। তারা শেষে বিহারীদের অন্য পথ দিয়ে নিয়ে যায়। বিহারীরা পরেশ মৃ’র দেখা পেলে হয়তো গুলি করে মেরেই ফেলত। ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পরেশ মৃ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন, খেতে দিতেন, চাঁদা তুলে হলেও টাকা পয়সা দিতেন।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুজিব সরকারও মান্দিদের উচ্ছেদ ও পুনর্বাসন করা হবে বলে ঘোষণা করে। পরেশ মৃ তখন বন মন্ত্রী, স্বরাস্ট্র মন্ত্রী, আইন মন্ত্রী এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে অনুরোধ করেন যাতে বনবাসীদের উৎখাত করা না হয় বন থেকে। কিন্তু তাতে ফল হয় নাই। শেষে পরেশ মৃ ‘বাঁচার দাবী’ নামে এক ঐতিহাসিক লিখিত দাবি পেশ করেন সরকারে কাছে। এর মধ্যে ছিলো, মান্দি ও অন্যান্য আদিবাসীদের যে পরিমাণ রেকর্ড জমি আছে, তত পরিমাণ জমি রেকর্ড করে দিতে হবে। যে পরিমাণ খাস জমি আছে, সম পরিমাণে খাস জমি দিতে হবে। পত্তনি জমি যে পরিমাণে আছে, সে পরিমাণে পত্তনি জমি দিতে হবে। আনারস চারা তুলে নেবার ও লাগানোর খরচ দিতে হবে। আম, কাঁঠাল ও অন্যান্য ফলের গাছ, বাঁশের মূল্য দিতে হবে। পুনর্বাসন হলে নতুন জায়গায় লাগানো আম, কাঁঠাল, আনারস ও অন্যান্য ফলের গাছে ফলন না হওয়া পর্যন্ত পুরানো বাগানের আনারস, কলা, আম, কাঁঠাল ও অন্যান্য ফলের গাছ খেতে ও বিক্রি করতে অনুমতি দিতে হবে। ঘরবাড়ি ভাঙার খরচ দিতে হবে। নতুন জায়গায় নতুন ঘরবাড়ি তৈরীর খরচ দিতে হবে। তাতে সরকার হিসেব করে দেখলেন যে, সরকারকে মোট দেড় কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পরে সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এভাবে মুজিব সরকারের উচ্ছেদ চেষ্টাও সাময়িক বন্ধ থাকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, একদল উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যের হাতে শেখ মুজিবর রহমান মারা গেলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। মোস্তাক আহম্মেদ সরকার পরিচালনা করে। তার সরকার বেশিদিন টিকে নাই, ভেঙে যায়। তারপর আসে আব্দুল সাত্তারের সরকার। তার সরকার কিছুদিন চলে। তার আমলে বাংলাদেশের আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। অনুষ্ঠান শেষে আদিবাসীরা নিজ নিজ এলাকার সমস্যার কথা তুলে ধরেন। পরেশ মৃও আবিমার আদিবাসীদের পক্ষে বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটের কথা তুলে ধরেন।সাত্তারের সরকার ভেঙে গেলে জিয়াউর রহমান বি.এন.পি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। সে সময় কাদের সিদ্দিকী ভয়ে ভারতের মেঘালয়ে পালিয়ে যায় এবং সেখানে কাদের বাহিনী নামে বিরাট দল গঠন করে। এবং তার বাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের যুবকদের আহবান জানান। তার আহবানে সাড়া দিয়ে বহু যুবক দলে দলে ভারত চলে যায়। কাদির সিদ্দীকি তাদের যুদ্ধবিদ্যা প্রশিক্ষণ দিতেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো জিয়ার সরকারকে উৎখাত করে পূণরায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করা। সে সময় করুনা কোচ নামে এক আদিবাসী কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিতে যাওয়ার সময় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হাতে ধরা পরে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় করুনা বলে যে, পরেশ মৃ তাকে কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই সূত্র ধরে একদিন হঠাৎ করে রাত দুইটায় মিলিটারী বাহিনী এসে পরেশ মৃ’র বাড়ি ঘেরাও করে। পরেশ মৃকে ধরে প্রথমে থানায় ও পরে টাঙ্গাইলে নিয়ে যায়। সরকারের লোক এসে এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এলাকার চ্যায়ারম্যান, মেম্বার, চৌকিদার, দফাদার ও অন্যান্য গ্রামের লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিলো যে, পরেশ মৃ কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিতে লোক পাঠায় কি না। সবাই না বলায় শেষ পর্যন্ত পরেশকে ছেড়ে দেয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর ও বিহারীরা শহরে, গ্রামে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়, ঘরবাড়ি ধ্বংশ করে, ধান-চাল লুট করে, গরু ছাগল জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে জবাই করে খেয়ে ফেলে । যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করার পর আওয়ামী লীগ সরকার নিঃস্ব হয়ে পড়া গরিব ও ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য রিলিপের ব্যবস্থা করে। সরকার অত্র এলাকার জন্য পরেশ মৃকে রিলিফের চ্যায়ারম্যান ও ডিলার মনোনীত করেন। রিলিফ বাবদ পরেশ মৃ-র বাড়িতে চাল, আটা, কাপড়চোপড়, শাড়ি, লুঙ্গি, শুকনা খাবার এবং নানারকম মালপত্র আসত। পরেশ মৃ সেসব সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে গরিব জনগণের মাঝে বিতরণ করে দেয়ার ব্যবস্থা করতেন। একবার তাই নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মনিটরিংয়ের জন্য একজন লোক পাঠানো হয় যে, রিলিফের মালপত্র পরেশ মৃ ঠিক মতো বিতরণ করছেন কি না, না কি সেসব বিক্রি করে বাড়ির জন্য আসবাব পত্র কিনেছেন, অথবা নতুন নতুন ঘরবাড়ি করেছেন । খাতা পত্র চেক করে সেরকম কোন ত্রুটি পায় নি।
পরেশ চন্দ্র মৃ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একবার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও কাউন্সিলয় চ্যায়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দিতা করেছিলেন। তার প্রতিদ্বন্দী ছিলেন পুরনো চ্যায়ারম্যান ইব্রাহিম সরকার। নির্বাচনে ৩৫০০ ভোটে নির্বাচিত হন ইব্রাহিম সরকার। পরেশ মৃ ২৬০০ ভোট পেয়ে পরাজিত হন। ইব্রাহিম ও তার দলের লোকেরা পরেশ মৃ জয়ী হলে তাকে মেরে ফেলার জন্য পরিকল্পনা করেছিলো। এরজন্য তারা একজন ভাড়াটে খুনীকে ৩০০০ হাজার টাকার জন্য চুক্তি করেছিলো। কিন্তু পরেশও জিতে নাই নির্বাচনে বিধায় তাকেও হত্যা করা হয় নাই। শেষে সেই লোকটি এসে পরেশ মৃ’র কাছে এসে সেসব বলে, ক্ষমা চায়, পরেশ মৃ ক্ষমা করে দেয়, ঈশ্বর ও তাকে ধন্যবাদ দেয়।
১৯৮০ সাল; ১৫ নং সামরিক আইন অনুযায়ী ন্যাশনাল পার্ক এলাকা থেকে ন্যাশনাল পার্কের ভিতর বসবাসকারী সকলকে উচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হয়। পরেশ মৃ ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ’-র কর্ণধার হিসেবে বনবাসী আদিবাসীদের উচ্ছেদ চেষ্টার বিরুদ্ধে লিখিত প্রতিবাদ পাঠান বিভিন্ন দেশি বিদেশি মানবাধিকার সংস্থ্যা, সংগঠনের কাছে। তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সাথে সরাসরি দেখা করেন, কথা বলেন। জিয়া তাঁকে অনেক সান্ত্বনার বাণী শুনান, আশ্বাস দেন। অবশেষে ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেন, মান্দিদের পার্ক এলাকা থেকে উচ্ছেদ করা হবে না। যে যেখানে আছে, সে সেখানেই থাকতে পারবে।
১৯৮২ সালে বন সীমানা ঠিক করার জন্য ভূমি জরিপ করা হয়। পরেশ মৃ ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে দেখা করে কার কত পরিমাণ রেকর্ড ও খাস জমি আছে তা জরিপের মাধ্যমে বন সীমানা ঠিক করার জন্য প্রস্তাব রাখেন। ম্যাজিস্ট্রেট সন্মতি দেয়। যাতে জনগণ বন সাফ করে জমি বাড়াতে না পারে।
কালেক্টার ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী আসে, জন প্রতিনিধি ও জমির মালিকের উপস্থিতিতে জমি সার্ভে করা হয়। ভূমি জরিপের মাধ্যমে বন ও দখলীস্বত্ব ও জমির সীমানা ঠিক করা হয়।
এক সময় ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক খিবরিয়াল খালেক , ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত পরেশ মৃ’র বাড়িতে অবস্থান করে মান্দি আদিবাসী ও তাদের বিবাহ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে থিসিস্ লিখেন। তিনি অস্ট্রেলিয়া ইউনিভার্সিটি হতে পি.এইচ.ডি নেয়ার জন্য এ্যান্ট্রোপলজি বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করছিলেন। মান্দিদের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্ম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন তিনি। এখানে অবস্থানকালে তিনি দেখতে পেলেন, বন বিভাগ বিভিন্ন সময়ে বনে বসবাসকারী মান্দি ও মান্দাই আদিবাসীদের উচ্ছেদের পায়তারা করেই যাচ্ছে। বনবাসী মানুষের সমস্যার উপর ভিত্তি করে তিনি ‘সোশ্যাল ফরেস্ট্রি ’ নামে একটি বই লিখেন। এবং তা বন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সরকারের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের নিকট পাঠান। বইটি পড়ে, বুঝে সরকার ও বন বিভাগ মধুপুরে বনবাসী আদিবাসীদের উচ্ছেদ বন্ধ রাখে।
১৯৮৪ সালে আবারো বন বিভাগ কার কত পরিমাণ চালা জমি, নামা জমি আছে, ভোগ দখল করে খাওয়া জমির পরিমাণ কত, পত্তনি ও রেকডকৃর্ত জমির কাগজপত্র বা দলিল পরচা আছে কি না , প্রমাণসহ জানাবার নোটিফিকেশন করে। এই কাজেও পরেশ মৃ সমস্ত মান্দি আদিবাসীদের জমির কাগজপত্র ও ম্যাপসহ বিভিন্ন সরকারী অফিস-আদালতে যান ও আলাপ আলোচনা করেন, সভা করেন।তাঁর এরকম অক্লান্ত , বিশ্রামহীন-বিরামহীন লেগে থাকার ফলেই মান্দি ও মান্দাই আদিবাসীরা বনের ভিতর আজ অব্দি বসবার করতে পারছে। যুগযুগ ধরে বসবাস করা নিজ গ্রাম হতে, নিজ বসতবাড়ি হতে তাহলে উচ্ছেদ হয়ে যেতে হতো কবেই তাদের।
১৯৮৪ ও ১৯৯২মসাল পর্যন্ত পরেশ মৃ-র স্বাস্থ্য ভালোই ছিলো। ১৯৯৩ থেকে ব্লাড প্রেসার আরম্ভ হয়। পরে ডায়াবেটিসও দেখা দেয়। ধীরে ধীরে তাঁর স্বাস্থ্য দুর্বল হতে থাকে। কানেও কম শুনতেন তখন। একসময় মানুষের সাথে বেশি কথা বলতেন না। প্রায়ই নীরব থাকতেন। এভাবে ৫ বছর কেটে যায়। অবশেষে ১৯৯৮ সালের ৭ ই মার্চ দীঘদিন রোগ-ভোগের পর ভোর ১২ঃ৩০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর মহাপ্রয়াণে শোকার্ত আ’বিমা তথা মধুপুরের জনগণ আদিবাসী অ-আদিবাসী তাকে শেষ বিদায় জানানোর জন্যে সকাল থেকে সবাই জড়ো হতে থাকে। তাঁর হাতে গড়া পীরগাছা সেন্ট পৌলস হাই স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকবৃন্দ এবং এলাকাবাসী তাঁর আত্মার শান্তির জন্যে প্রার্থনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। প্রথমে তাঁর মৃত দেহকে শব-শোভাযাত্রার মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয় পীরগাছা ধর্মপল্লির গির্জায়। গির্জায় প্রার্থনা পরিচালনা করেন ফাদার ইউজিন হোমরিক সি. এস. সি। প্রার্থনা শেষে গির্জা থেকে বাড়িতে এনে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। সে সময় এলাকার আদিবাসী , অ-আদিবাসী, বিভিন্ন সংস্থার সমাজকর্মী ও কর্মকর্তাবৃন্দ , এলাকার চেয়াম্যান-মেম্বার এবং তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ ভক্ত শিষ্যগণ উপস্থিত ছিলেন।
পান। সাথে সাথে পরেশ মৃ ধর্ম প্রচারও করতেন এবং গ্রামবাসীর মন পরিবর্তনের জন্য প্রার্থনা করতেন। প্রত্যেক পরিবার যেন নিজ নিজ ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়, লেখাপড়া শেখায় এর জন্য পরেশ মৃ গ্রামবাসীকে উৎসাহ যোগাতেন, উপদেশ ও পরামর্শ দিতেন।
শিক্ষার আলো নতুন জীবন ও পথ দেখায়। অজ্ঞতা, অন্ধতা ও কু-সংস্কারাচ্ছন্নতা হতে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড, উন্নয়নের মূল উৎস, কেন্দ্র ও ভিত্তি। পরেশ মৃ তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি এলাকার মানুষকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য ১৯৭২ সালে পীরগাছায় ‘পীরগাছা সাধু পৌলের উচ্চ বিদ্যালয় ’ নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এলাকাবাসীর সহযোগিতায়। বর্তমানে যেখানে কম্পিউটার ঘরটি সেখানে প্রথমে বেড়ার ও পরে মাটির ঘর তৈরী হয়েছিলো। প্রাথমিক অবস্থায় ঘর তৈরীর কাজ খুব কঠিন ছিলো। তবে পরেশ মৃ-র নেতৃত্বে ধীরে ধীরে স্কুল ভবন তৈরীর কাজ এগিয়ে যায়। প্রথমে স্কুল ঘরের জন্য জমি নির্বাচন করা হয়। এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি চাওয়া, জমির মূল্য নির্ধারণ করা, জলছত্র মিশনের ফাদারের সাথে যোগাযোগ করা এসব পরেশ মৃ করতেন। শ্যামচরণ রেমা নাম মাত্র মূল্যে প্রায় ৫ একর জমি স্কুলের জন্য দেন। তিনি গ্রামের লোকদের নিয়ে ফরেস্টার, রেঞ্জারের সাথে দেখা করে স্কুল ঘরের জন্য কাঠ চান। অনুমতি পাবার পর বন থেকে কাঠ কেটে এনে চিরাই করা, রুয়া-সারক কাটা, ধন্না কাটা, ঘরের জন্য জানলা দরোজা, বেঞ্চ বানানো, কামলা, স্বেচ্ছাশ্রম যোগার ইত্যাদি যাবতীয় কাজ নিজে তদারকী করতেন। দীর্ঘদিন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির চ্যায়ারম্যান পদে থেকে সুষ্ঠুভাবে স্কুল পরিচালনায় সহায়তা করে গেছেন তিনি।তিনি ছিলেন ‘পীরগাছা সাধু পৌলের উচ্চ বিদ্যালয় ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ‘পীরগাছা সাধু পৌলের উচ্চ বিদ্যালয় ’-এর পূর্ব পার্শ্বের একটি ভবনকে তাঁর নামে নামাকরণ করে রাখা হয়েছে ‘পরেশ চন্দ্র মৃ হল রুম’ হিসেবে। ফাদার হোমরিক যখন জলছত্র মিশনে আসেন তখন নতুন করে পীরগাছা গ্রামে গীর্জা ঘর ও প্রাইমারি স্কুল নির্মিত হয়। পরেশ মৃর নেতৃত্বে গ্রামের লোকেরা গীর্জা ঘর ও প্রাইমারি স্কুল ঘর নির্মাণের কাজে সহায়তার জন্য আসত। ফাদার হোমরিক জলছত্র মিশনে আসার আগে পীরগাছা প্রাইমারি স্কুল ছিলো সরকারী বোর্ড স্কুল। এখানে বাঙালি শিক্ষক মিঃ এডুইন রোজারিও শিক্ষকতা করতেন। একবার লম্বা ছুটিতে তিনি বাড়ি যান। স্কুল খোলার তারিখ মতো তিনি আসেন নাই। দেরী করে আসেন। একদিন দেরীতে স্কুল খোলার সময় স্কুল পরিদর্শক হঠাৎ করে এসে উপস্থিত হন। তিনি দেখতে পেলেন ছাত্র নেই, স্কুল ঘর নোংরা আবর্জনায় ভরা। তিনি বোর্ড স্কুল কেটে ভেঙে দেন। তখন ফাদার স্টিফেন ডায়াস জলছত্র মিশনে ছিলেন। তিনি মনে করলেন বোর্ড স্কুল ভেঙে গেলেও মিশন প্রাইভেট প্রাইমারি স্কুল হিসেবে রাখতে হবে। ছেলেমেয়েরা যেন শিক্ষার আলো পায়। সাথে সাথে ধর্ম প্রচারও যেন চলতে থাকে। এ কাজে ফাদার চুনিয়ার পরেশ মৃ-কে আহবান করেন। ফাদারের আহবানে পরেশ মৃ সাড়া দেন ও কাজ করতে শুরু করেন। তখন স্কুল ছিলো পীরগাছায়, আর গীর্জা ঘর ছিলো চুনিয়াতে দেবেন দফো’র বাড়িতে।
পীরগাছা ও চুনিয়ার লোকেরা মিলেমিশে গীর্জা ঘরে প্রার্থনা ও আরাধনা করতো। ফাদার স্টিফেন ডায়াস ও ফাদার হোমরিক মাঝে মাঝে মিশা দিতে আসতেন। আর্চ বিশপ গ্রেনারও হস্তার্পণ দিতে আসতেন। গ্রেনার স্বদেশে চলে গেলে বিশপ অমল গাঙ্গুলিও হস্তার্পণের জন্য চুনিয়ায় আসতেন। ময়মনসিংহ ডায়োসিসের বিশপ ফ্রান্সিসের (প্রয়াত) বড় ভাই জন গমেজকে ধর্ম প্রচারের কাজে পীরগাছায় পাঠানো হয়। মিঃ পরেশ মৃ, মিঃ জীবন নকরেক, মিঃ দেবেন দফো প্রমুখ ব্যাক্তিগণ জন গমেজকে ধর্ম প্রচারের কাজে সহায়তা করতেন। তাদের অক্লান্ত চেষ্টা, পরিশ্রমের ফলে বহু সাংসারেক মান্দি খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলো। একবার একদিনেই ৬০ জন লোক খ্রিস্ট ধর্মে বাপ্তিষ্ম গ্রহণ করেছিলো। ধীরে ধীরে উত্তর চুনিয়া ও দক্ষিণ চুনিয়াতে বহু নরনারী খ্রিস্টা ধর্মে দীক্ষিত হয়। পীরগাছায় খ্রিস্ট বিশ্বাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে চুনিয়ার গীর্জা ঘর পীরগাছায় আনা হয়। গীর্জা ঘরের জন্য মাটির দেওয়াল তোলার সময় পরেশ মৃ কামলা যোগার করে , গ্রামবাসীকে স্বেচ্ছাশ্রম দেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। ঘরের জন্য বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করার জন্য বন বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে অর্থাৎ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে।
১৯৫২ সালে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হলে গারোদের প্রধান জাতীয় পেশা জুম চাষ বন্ধ হয়ে যায়। এতে গারোরা অসুবিধায় ভোগে। তখন গরিব ও বনবাসী মান্দিরা বনে জুম চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করত। জীবিকার উপর এরকম নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা সামলে ওঠা গারোদের জন্য খুবই কঠিন হয়ে পড়েছিলো। ১৯৫৬ সালে বন বিভাগ চুনিয়াতে লট করা আরম্ভ করে। প্রতিটি লটে ১০ একর জমি থাকত। বন বিভাগের মানুষ লটের গাছ সমূহ নিলামে বিক্রি করে দিত। বড় বড় মহাজনেরা লটের গাছ কিনে নিত। লটের গাছ বিক্রি করার পর লট পরিস্কার হলে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার পর গারোরা জমি ভাগ করে নিয়ে সেখানে ধান, পাট, সরষে ও অন্যান্য ফসল চাষ করত। বন বিভাগ মান্দিদের আবাদী জমিতে গজারি গাছের বীজ রোপন করত। মান্দিদের আবাদী জমি বাদ দিয়ে যাতে লট করা হয় এরজন্য পরেশ মৃ বন বিভাগের বড় বড় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে কথা বলতেন । তারা তাঁর কথা শুনেন, বিবেচনা করেন। এবং মানবতার খাতিরে আবাদী জমিগুলো বাদ দেয়।
১৯৫৫ সালে পাকিস্তান শাসন আমলে বন বিভাগ ও তার কর্তৃপক্ষ সারা পূর্ব পাকিস্তানের আওতাভূক্ত ১৯১৩ সাল থেকে ১৯১৯ সালের সি.এস.সি রেকর্ড বাদে সমস্ত পত্তনি জমি নোটিফিকেশনের মাধ্যমে খাস ঘোষণা করে এবং গাছ লাগানো শুরু করে বন বাড়ানোর জন্য। সে সময় পত্তনি জমি বন বিভাগের কাছ থেকে রক্ষার জন্য পরেশ মৃ এলাকার লোকদের নিয়ে লড়াই করে । অবশেষে পত্তনি জমি বাদ দিয়ে বন বিভাগ বন সৃজন করে। পরেশ মৃ-র অক্লান্ত পরিশ্রম সার্থক হয়।
ভালুকা থানাধীন নলুয়াকুরী গ্রামের বঙ্ক চিসিম ও কুমুদিনী দারুর মেয়ে শিশিলিয়া দারুর সাথে ১৯৫৬ সালে বিয়ে হয় পরেশ মৃ’র। পরেশের বাবার নাম ছিলো রায়চান নকরেক। রায়চান নকরেকের ২ জন পত্নী ছিলো -টেংয়া মৃ ও ছেংয়া মৃ। টেংয়া মৃ বহুদিন যাবৎ নিঃসন্তান ছিলেন। বংশ রক্ষা ও বংশের প্রদ্বীপ জ্বালাবার জন্য সন্তান লাভের আশায় রায়চান নকরেক ২য় বিবাহ করেন ছেংয়া মৃকে। কিন্তু শেষে প্রথম স্ত্রী টেংয়া মৃ-র কোলেই ২ জন সন্তানের জন্ম হয়। গজেন মৃ ও পরেশ মৃ টেংয়া মৃ’র কোলেই জন্ম হয়। শেষ পর্যন্ত রায়চান নকরেকের ২য় স্ত্রী ছেংয়া মৃ নিঃসন্তানই থেকে যান।রায়চান নকরেক গজেন মৃ ও পরেশ মৃ দুই ভাইকে প্রায়মারি ও মাধ্যমিক স্কুল পর্যন্ত পড়ান। এবং দুই ভাইয়ের জন্যেই বাড়িতে বউ এনে দেন। সে সময় রায়চানকে অনেকেই পরামর্শ দিত, তুমি দুই ভাহকে জামাই পাঠিয়ে দাও। বরং সাদু, আদার কাছ (ভাইরা) থেকে নক্না (পোষ্য মেয়ে) এনে জামাই আন। তারা তোমার লালন পালন করবে, যত্ন আত্তি করবে ও দেখাশোনা করবে। ছেলের বউয়েরা তোমার দেখশোনা করবে না, সেবা করবে না । কিন্তু রায়চান তাদের কথা , পরামর্শ ও যুক্তি শুনেন নাই। দুই ছেলের জন্য বাড়িতে বউ এনে যৌথ পরিবারের মতো থাকতেন। রায়চান তার সম্পত্তি তিন ভাগে ভাগ করেছিলো এভাবে-১. পরেশ মৃ ২. গজেন মৃ এবং ৩. রায়চান, টেংয়া ও ছেংয়া-র জন্য। গ্রামে সে সময়কার গ্রু-খামাল (আইনবিদ) সারিনাথ নকরেক ছিলেন রায়চান নকরেকের বড় ভাইরা। সারিনাথ নকরেক রায়চান নকরেককে পরামর্শ দিলেন- শেষের ভাগের সম্পদ মৃ মাহারির সম্পদ হিসেবে রাখতে হবে। গজেনের স্ত্রী রুগা, এবং পরেশের স্ত্রী দারু তারা এর ভাগ পাবে না। গজেন অথবা পরেশ যদি সামাজিক অন্যায় করে (গ্রুনাংয়ে রনও, রুগা দারু গ্রি না গ্রু গাম না নাংন। রুগা , দারু গ্রু চাগিপা)। সে সময় মৃ ও দারু, রুগা চাচ্চিরাসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিগণ উপস্থিত ছিলেন। সবাই তার কথা মেনে নেয়। পরে রায়চান নকরেক গজেন মৃ ও পরেশ মৃ’কে বলেন-তোমরা তোমাদের ছেলেদের জন্য মৃ মাহারির বউ নিয়ে আসবে তাহলেই হবে। গজেন মৃ ও পরেশ মৃ বাবা রায়চান নকরেকের কথা মেনে নিয়েছিলেন। গজেন মৃ তার ছেলের জন্য মৃ মাহারি বউ এনেছেন। পরেশ মৃও ছেলের জন্য মৃ মাহারি বউ এনেছেন। পরেশ মৃ তার বাবা, মা ও সৎ মাকে দেখা শোনা করে গেছেন, চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন।
১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের আমলে দোখলা ন্যাশনাল পার্ক করা হয়। ৪০ বর্গ মাইল জমি তারের বেড়া দিয়ে এর অন্তর্ভূক্ত করা হয়। চুনিয়া, পীরগাছা, ভূটিয়া, সাইনামারী, থানারবাইদ, হাগুড়াকুড়ী, জয়নাগাছা, বেদুরিয়া, সাধুপাড়া, গাইরা, টেলকি, জলই, কাকড়াগুণী প্রভৃতি মান্দি অধ্যুষিত গ্রাম এর আওতায় পড়ে। সাথে সাথে বন বিভাগের কর্মচারীরা মান্দিসহ অন্যান্য আদিবাসীদের উচ্ছেদের কথা মৌখিকভাবে জানিয়েও দেয়।
১৯৬২ সালের ৫ ই এপ্রিল ‘জলছত্র জয়েনশাহী আদিবাসী ঋণ দান সমবায সমিতি লিঃ’- গঠন করা হয় ক্রেডিট আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ফাদার জে ইয়াং কর্তৃক। তখন ফাদার ইয়াং পরেশ মৃকে হিসাব রক্ষণের কাজ করানোর জন্য হিসাব নিকাশ ও বুক কিপিংয়ের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। পরেশ চন্দ্র মৃ বহু বছর জলছত্র ক্রেডিটের পরিচালনা ও সেবা দান করে গেছেন। পরেশ চন্দ্র মৃ ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ’এরও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ১৯৬২ সালের ২ ই মার্চ এলাকাবাসীকে নিয়ে তিনি ঐতিহাসিক এই সংগঠনের জন্ম দেন। অদ্যাবদি আবিমার তথা মধুপুর, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়ার আদিবাসীরা এই সংগঠনের নেতৃত্বেই বিভিন্ন সামাজিক ও জাতীয় ইস্যুতে প্রতিবাদ করে, সমস্যাসমূহের সমাধানের উপায় বার করে। তিনি বিচক্ষণতার সাথে ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ’ সংগঠনের দ্বারা বহু সামাজিক ও জাতীয় বিপদসমূহ মোকাবেলা করেন, বনে টিকে থাকার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন।
১৯৬২ সনে পাকিস্তান সরকার শুধু চুনিয়া গ্রামবাসীকে সরিয়ে অন্য জায়গায় পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করে। তখন যাবতীয় তথ্য বিশেষ করে কার কত খাস ও পত্তনি জমি আছে, কত একর বাগান আছে, কয়টা আম, কাঁঠাল গাছ আছে, আনারস বাগানে কত হাজার আনারসের চারা আছে, অন্যান্য ফলের গাছ কয়টা আছে, টিনের ঘর কয়টা, ছনের ঘর কয়টা, হাঁস-মুরগী কয়টা, শুকর কয়টা, পরিবারের সদস্য সংখ্যা কয়জন ইত্যাদি তথ্য সার্ভে করা শুরু করে। পাকিস্তান সরকার দেখলো ও চিন্তা করলো যে, চুনিয়ার মানুষগুলো বড়ই শক্ত ও যুক্তিবাজ। নানান যুক্তি টাল বাহানা দেখায়। চুনিয়ার মানুষকে সরাতে পারলেই অন্যান্য গ্রামের মানুষকেও সহজেই উচ্ছেদ করা যাবে। চুনিয়া গ্রামবাসী তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কিন্ত একজন পরেশ মৃ দৃঢ়তার সাথে তাদের পাশে ছিলেন, ভয়ে সাহস দিতেন, সান্ত¦না দিতেন। বলতেন-তোমরা ভয় করো না, ঈশ্বর আমাদের এই সমস্যা থেকে রক্ষা করবেন ও বাঁচাবেন। ১৯৬৪ সালে কলমাকান্দা, নালিতা বাড়ি, হালুয়াঘাট, দূর্গাপুর ও শ্রীবর্দী থানার গারো, হাজং, ডালু, বানাই, হদি ও অন্যান্য যত আদিবাসী ছিলো তারা সবাই সীমান্তবর্তী রক্ষী বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ণ এবং গ্রামে চুরি, ডাকাতি, লুটপাত, খুন, নারী নির্যাতন ইত্যাদি দেখে অতিষ্ঠ হয়ে, ভয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে (আসাম) পালিয়ে যায়। এ ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারকে অবহিত করা হলে সরকার কোন প্রকার ব্যবস্থা নিত না। দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার চিন্তা করত না।
দেশের অরাজক পরিস্থিতিতে বর্ডার এলাকার আদিবাসীদের পালানো দেখে আবিমার (জয়েনশাহী) আদিবাসীরাও চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিলো, আমরা থাকতে পারব না, আমাদেরও পালাতে হবে। থাকলে সকলকেই মরতে হবে। কিন্তু পরেশ মৃ সকলকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন যে, আমাদের পালাতে হবে না। আমাদের কিছু হবে না। আমরা যে যেখানে যেভাবে আছি সেভাবেই থাকব। আমাদের শান্তি, নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা আসবেই। ঈশ্বর আমাদের সকল বিপদ, সংকট থেকে রক্ষা করবেন। ভারতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যারা পালিয়ে গেছে তারাও আলোচনা , সমালোচনা করতে লাগলেন- পরেশ মৃ আসলেই আবিমার মান্দিরাও আসত, বাঁচত। তারা সবাই মুসলমানদের অত্যাচার, উৎপাত ও নিপীড়নে মারা যাবে। কিন্তু পরেশ মৃ জানতেন যে একবার এলাকা ছেড়ে চলে গেলে পরে ফিরে এসে জায়গা জমি, ঘরবাড়ি, ভিটে, গরু-ছাগল কিছুই পাওয়া যাবে না। সব বেদখল হয়ে যাবে।
১৯৬৪ সালের দিকে পরেশ মৃ আবার টিবি রোগে আক্রান্ত হন। তিন মাস বারমারী হসপিটালে চিকিৎসার জন্য ছিলেন। সে সময়েই তাঁর মা টেংয়া মৃ মারা যায়। মার মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন পরেশ মৃ। পরে তাকে ঢাকার হলিফ্যামিলি হসপিটালে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। ময়মনসিংহের সেন্ট মাইকেল হসপিটালে রেখে তার চিকিৎসা চলতে থাকে। মাঝে মাঝে ঢাকায় পাঠানো হতো পরীক্ষার জন্য। এখানে তিন মাসের মতো চিকিৎসার পর সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেন পরেশ মৃ।
১৯৬৭ সনে দোখলার জাতীয় পার্কে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান আসেন। পার্ক এলাকার সমস্ত আদিবাসীদের সরিয়ে দিয়ে বাইরে পুনর্বাসনের ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু পরেশ মৃ সবাইকে নিয়ে পার্কের ভিতর বসবাস করতে থাকেন। এবং ১৯৬৮ সালে যথারীতি উচ্ছেদের নোটিশ পাঠানোও হয় চুনিয়া গ্রামবাসীর জন্য। নোটিশে উচ্ছেদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ন্যায্য ও উচিত মূল্য দেয়া হবে বলে বলা হয়। গ্রামের সরল লোকদের অনেকেই ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তখন। কিন্তু পরেশ চিন্তা করলেন, টাকা নিলেই বিপদ ঘনিয়ে আসবে। তৎক্ষণাৎ পরেশ মৃ মাস্টার দেবেন দফোকে সাথে নিয়ে ময়মনসিংহে চলে যান এ বিষয়ে কথা বলার জন্য। ম্যাজিস্ট্র্যাট, ডিপো ও অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট লিখিত দরখাস্ত দেন এভাবে যে, জাতীয় পার্ক হোক আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা যে যেখানে, যেভাবে আছি সেখানে, নিজ নিজ জায়গায়, নিজ জমাজমিতে, ঘর বাড়িতে যেন থাকতে পারি। সেখান থেকে যেন আমাদের উচ্ছেদ করা না হয়। বনে জন্মেছি, বনেই বেড়ে উঠেছি। এই বন জীবনে আমরা এতোটাই অভ্যস্ত যে, এখান থেকে উচ্ছেদ করলে আমরা বাঁচতে পারব না। আবেদনের পর সাময়িক উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধ ছিলো।
১৯৬৯-১৯৭০ সনে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিহারীরা পরেশ মৃ’কে দেখার জন্য তাঁর বাড়ি যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু পথ দেখানোর জন্য যাদের আনা হয়েছিলো তারা বিহারীদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলো যে, পরেশ মৃ’র বাড়ি গভীর বনের ভিতর। অনেক দূরে। তারা শেষে বিহারীদের অন্য পথ দিয়ে নিয়ে যায়। বিহারীরা পরেশ মৃ’র দেখা পেলে হয়তো গুলি করে মেরেই ফেলত। ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পরেশ মৃ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন, খেতে দিতেন, চাঁদা তুলে হলেও টাকা পয়সা দিতেন।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুজিব সরকারও মান্দিদের উচ্ছেদ ও পুনর্বাসন করা হবে বলে ঘোষণা করে। পরেশ মৃ তখন বন মন্ত্রী, স্বরাস্ট্র মন্ত্রী, আইন মন্ত্রী এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে অনুরোধ করেন যাতে বনবাসীদের উৎখাত করা না হয় বন থেকে। কিন্তু তাতে ফল হয় নাই। শেষে পরেশ মৃ ‘বাঁচার দাবী’ নামে এক ঐতিহাসিক লিখিত দাবি পেশ করেন সরকারে কাছে। এর মধ্যে ছিলো, মান্দি ও অন্যান্য আদিবাসীদের যে পরিমাণ রেকর্ড জমি আছে, তত পরিমাণ জমি রেকর্ড করে দিতে হবে। যে পরিমাণ খাস জমি আছে, সম পরিমাণে খাস জমি দিতে হবে। পত্তনি জমি যে পরিমাণে আছে, সে পরিমাণে পত্তনি জমি দিতে হবে। আনারস চারা তুলে নেবার ও লাগানোর খরচ দিতে হবে। আম, কাঁঠাল ও অন্যান্য ফলের গাছ, বাঁশের মূল্য দিতে হবে। পুনর্বাসন হলে নতুন জায়গায় লাগানো আম, কাঁঠাল, আনারস ও অন্যান্য ফলের গাছে ফলন না হওয়া পর্যন্ত পুরানো বাগানের আনারস, কলা, আম, কাঁঠাল ও অন্যান্য ফলের গাছ খেতে ও বিক্রি করতে অনুমতি দিতে হবে। ঘরবাড়ি ভাঙার খরচ দিতে হবে। নতুন জায়গায় নতুন ঘরবাড়ি তৈরীর খরচ দিতে হবে। তাতে সরকার হিসেব করে দেখলেন যে, সরকারকে মোট দেড় কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পরে সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এভাবে মুজিব সরকারের উচ্ছেদ চেষ্টাও সাময়িক বন্ধ থাকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, একদল উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যের হাতে শেখ মুজিবর রহমান মারা গেলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। মোস্তাক আহম্মেদ সরকার পরিচালনা করে। তার সরকার বেশিদিন টিকে নাই, ভেঙে যায়। তারপর আসে আব্দুল সাত্তারের সরকার। তার সরকার কিছুদিন চলে। তার আমলে বাংলাদেশের আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। অনুষ্ঠান শেষে আদিবাসীরা নিজ নিজ এলাকার সমস্যার কথা তুলে ধরেন। পরেশ মৃও আবিমার আদিবাসীদের পক্ষে বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটের কথা তুলে ধরেন।সাত্তারের সরকার ভেঙে গেলে জিয়াউর রহমান বি.এন.পি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। সে সময় কাদের সিদ্দিকী ভয়ে ভারতের মেঘালয়ে পালিয়ে যায় এবং সেখানে কাদের বাহিনী নামে বিরাট দল গঠন করে। এবং তার বাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের যুবকদের আহবান জানান। তার আহবানে সাড়া দিয়ে বহু যুবক দলে দলে ভারত চলে যায়। কাদির সিদ্দীকি তাদের যুদ্ধবিদ্যা প্রশিক্ষণ দিতেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো জিয়ার সরকারকে উৎখাত করে পূণরায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করা। সে সময় করুনা কোচ নামে এক আদিবাসী কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিতে যাওয়ার সময় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হাতে ধরা পরে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় করুনা বলে যে, পরেশ মৃ তাকে কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই সূত্র ধরে একদিন হঠাৎ করে রাত দুইটায় মিলিটারী বাহিনী এসে পরেশ মৃ’র বাড়ি ঘেরাও করে। পরেশ মৃকে ধরে প্রথমে থানায় ও পরে টাঙ্গাইলে নিয়ে যায়। সরকারের লোক এসে এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এলাকার চ্যায়ারম্যান, মেম্বার, চৌকিদার, দফাদার ও অন্যান্য গ্রামের লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিলো যে, পরেশ মৃ কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিতে লোক পাঠায় কি না। সবাই না বলায় শেষ পর্যন্ত পরেশকে ছেড়ে দেয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর ও বিহারীরা শহরে, গ্রামে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়, ঘরবাড়ি ধ্বংশ করে, ধান-চাল লুট করে, গরু ছাগল জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে জবাই করে খেয়ে ফেলে । যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করার পর আওয়ামী লীগ সরকার নিঃস্ব হয়ে পড়া গরিব ও ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য রিলিপের ব্যবস্থা করে। সরকার অত্র এলাকার জন্য পরেশ মৃকে রিলিফের চ্যায়ারম্যান ও ডিলার মনোনীত করেন। রিলিফ বাবদ পরেশ মৃ-র বাড়িতে চাল, আটা, কাপড়চোপড়, শাড়ি, লুঙ্গি, শুকনা খাবার এবং নানারকম মালপত্র আসত। পরেশ মৃ সেসব সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে গরিব জনগণের মাঝে বিতরণ করে দেয়ার ব্যবস্থা করতেন। একবার তাই নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মনিটরিংয়ের জন্য একজন লোক পাঠানো হয় যে, রিলিফের মালপত্র পরেশ মৃ ঠিক মতো বিতরণ করছেন কি না, না কি সেসব বিক্রি করে বাড়ির জন্য আসবাব পত্র কিনেছেন, অথবা নতুন নতুন ঘরবাড়ি করেছেন । খাতা পত্র চেক করে সেরকম কোন ত্রুটি পায় নি।
পরেশ চন্দ্র মৃ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একবার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও কাউন্সিলয় চ্যায়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দিতা করেছিলেন। তার প্রতিদ্বন্দী ছিলেন পুরনো চ্যায়ারম্যান ইব্রাহিম সরকার। নির্বাচনে ৩৫০০ ভোটে নির্বাচিত হন ইব্রাহিম সরকার। পরেশ মৃ ২৬০০ ভোট পেয়ে পরাজিত হন। ইব্রাহিম ও তার দলের লোকেরা পরেশ মৃ জয়ী হলে তাকে মেরে ফেলার জন্য পরিকল্পনা করেছিলো। এরজন্য তারা একজন ভাড়াটে খুনীকে ৩০০০ হাজার টাকার জন্য চুক্তি করেছিলো। কিন্তু পরেশও জিতে নাই নির্বাচনে বিধায় তাকেও হত্যা করা হয় নাই। শেষে সেই লোকটি এসে পরেশ মৃ’র কাছে এসে সেসব বলে, ক্ষমা চায়, পরেশ মৃ ক্ষমা করে দেয়, ঈশ্বর ও তাকে ধন্যবাদ দেয়।
১৯৮০ সাল; ১৫ নং সামরিক আইন অনুযায়ী ন্যাশনাল পার্ক এলাকা থেকে ন্যাশনাল পার্কের ভিতর বসবাসকারী সকলকে উচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হয়। পরেশ মৃ ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ’-র কর্ণধার হিসেবে বনবাসী আদিবাসীদের উচ্ছেদ চেষ্টার বিরুদ্ধে লিখিত প্রতিবাদ পাঠান বিভিন্ন দেশি বিদেশি মানবাধিকার সংস্থ্যা, সংগঠনের কাছে। তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সাথে সরাসরি দেখা করেন, কথা বলেন। জিয়া তাঁকে অনেক সান্ত্বনার বাণী শুনান, আশ্বাস দেন। অবশেষে ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেন, মান্দিদের পার্ক এলাকা থেকে উচ্ছেদ করা হবে না। যে যেখানে আছে, সে সেখানেই থাকতে পারবে।
১৯৮২ সালে বন সীমানা ঠিক করার জন্য ভূমি জরিপ করা হয়। পরেশ মৃ ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে দেখা করে কার কত পরিমাণ রেকর্ড ও খাস জমি আছে তা জরিপের মাধ্যমে বন সীমানা ঠিক করার জন্য প্রস্তাব রাখেন। ম্যাজিস্ট্রেট সন্মতি দেয়। যাতে জনগণ বন সাফ করে জমি বাড়াতে না পারে।
কালেক্টার ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী আসে, জন প্রতিনিধি ও জমির মালিকের উপস্থিতিতে জমি সার্ভে করা হয়। ভূমি জরিপের মাধ্যমে বন ও দখলীস্বত্ব ও জমির সীমানা ঠিক করা হয়।
এক সময় ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক খিবরিয়াল খালেক , ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত পরেশ মৃ’র বাড়িতে অবস্থান করে মান্দি আদিবাসী ও তাদের বিবাহ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে থিসিস্ লিখেন। তিনি অস্ট্রেলিয়া ইউনিভার্সিটি হতে পি.এইচ.ডি নেয়ার জন্য এ্যান্ট্রোপলজি বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করছিলেন। মান্দিদের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্ম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন তিনি। এখানে অবস্থানকালে তিনি দেখতে পেলেন, বন বিভাগ বিভিন্ন সময়ে বনে বসবাসকারী মান্দি ও মান্দাই আদিবাসীদের উচ্ছেদের পায়তারা করেই যাচ্ছে। বনবাসী মানুষের সমস্যার উপর ভিত্তি করে তিনি ‘সোশ্যাল ফরেস্ট্রি ’ নামে একটি বই লিখেন। এবং তা বন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সরকারের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের নিকট পাঠান। বইটি পড়ে, বুঝে সরকার ও বন বিভাগ মধুপুরে বনবাসী আদিবাসীদের উচ্ছেদ বন্ধ রাখে।
১৯৮৪ সালে আবারো বন বিভাগ কার কত পরিমাণ চালা জমি, নামা জমি আছে, ভোগ দখল করে খাওয়া জমির পরিমাণ কত, পত্তনি ও রেকডকৃর্ত জমির কাগজপত্র বা দলিল পরচা আছে কি না , প্রমাণসহ জানাবার নোটিফিকেশন করে। এই কাজেও পরেশ মৃ সমস্ত মান্দি আদিবাসীদের জমির কাগজপত্র ও ম্যাপসহ বিভিন্ন সরকারী অফিস-আদালতে যান ও আলাপ আলোচনা করেন, সভা করেন।তাঁর এরকম অক্লান্ত , বিশ্রামহীন-বিরামহীন লেগে থাকার ফলেই মান্দি ও মান্দাই আদিবাসীরা বনের ভিতর আজ অব্দি বসবার করতে পারছে। যুগযুগ ধরে বসবাস করা নিজ গ্রাম হতে, নিজ বসতবাড়ি হতে তাহলে উচ্ছেদ হয়ে যেতে হতো কবেই তাদের।
১৯৮৪ ও ১৯৯২মসাল পর্যন্ত পরেশ মৃ-র স্বাস্থ্য ভালোই ছিলো। ১৯৯৩ থেকে ব্লাড প্রেসার আরম্ভ হয়। পরে ডায়াবেটিসও দেখা দেয়। ধীরে ধীরে তাঁর স্বাস্থ্য দুর্বল হতে থাকে। কানেও কম শুনতেন তখন। একসময় মানুষের সাথে বেশি কথা বলতেন না। প্রায়ই নীরব থাকতেন। এভাবে ৫ বছর কেটে যায়। অবশেষে ১৯৯৮ সালের ৭ ই মার্চ দীঘদিন রোগ-ভোগের পর ভোর ১২ঃ৩০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর মহাপ্রয়াণে শোকার্ত আ’বিমা তথা মধুপুরের জনগণ আদিবাসী অ-আদিবাসী তাকে শেষ বিদায় জানানোর জন্যে সকাল থেকে সবাই জড়ো হতে থাকে। তাঁর হাতে গড়া পীরগাছা সেন্ট পৌলস হাই স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকবৃন্দ এবং এলাকাবাসী তাঁর আত্মার শান্তির জন্যে প্রার্থনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। প্রথমে তাঁর মৃত দেহকে শব-শোভাযাত্রার মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয় পীরগাছা ধর্মপল্লির গির্জায়। গির্জায় প্রার্থনা পরিচালনা করেন ফাদার ইউজিন হোমরিক সি. এস. সি। প্রার্থনা শেষে গির্জা থেকে বাড়িতে এনে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। সে সময় এলাকার আদিবাসী , অ-আদিবাসী, বিভিন্ন সংস্থার সমাজকর্মী ও কর্মকর্তাবৃন্দ , এলাকার চেয়াম্যান-মেম্বার এবং তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ ভক্ত শিষ্যগণ উপস্থিত ছিলেন।